Sunday, August 2, 2015

বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবা

আমি একজন ভাল রাঁধুনি।কিন্তু পরিমিত উপকরন না পেলে আমি রান্না করি না।ভাল বাবুর্চিরাও কিন্তু তাই করে থাকে। পর্যাপ্ত জিনিস না দিলে সে রাঁধতে চাইবে না। বাজারের তাজা মাছটি, ফ্রেস মাংসটি, ফ্রেস সবজী এবং প্রয়োজনীয় তেল মসলা না হলে খাবার মজা হবে কি করে? তাই আমি মনের মত করে সব উপকরন সংগ্রহ করে সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করাই। আমি একজন ভাল চিকিৎসকও। কিন্তু সর্বোত্তম সেবাটি দেবার জন্য আমি কি সব উপকরন মনের মত পাই? উত্তরঃ সরকারী পর্যায়ে - না কখনও পাই না আর বেসরকারী পর্যায়ে কখনও পাই না কখনও বা গ্রাহকের অপারগতার জন্য দিতে পারিনা। কারন এক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চিকিৎসক আমি। যেখানে না সরকার পুরো দায়িত্ব নেয় না জনগণের সামর্থ আছে। বেনারসীর বদলে আটপৌরে শাড়ী পরে আবরু রক্ষা করা যায়, কাচ্চি বিরিয়ানীর বদলে পান্তা মরিচ দিয়েও ক্ষুধা নিবারন করা যায়, অট্টালিকার পালঙ্কে না শুয়েও কুঁড়েঘরের মাটির বিছানায় নিদ্রাযাপন করা যায় কিন্তু রক্তের বদলে পানি দিয়ে চিকিৎসা করা যায় না। চিকিৎসার জন্য ধনী লোকটির শরীর যা চায়, হত দরিদ্র লোকটির শরীরও তাই চায়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল কিংবা বড় বড় শহরের হাসপাতালগুলোতেও কি সকল সার্ভিস দেয়া যাচ্ছে ? পর্যাপ্ত দেয়া যাচ্ছে না । ফলাফল জনরোষ এবং চিকিৎসক নির্যাতন। আর অকারনে মার খেয়ে যাচ্ছে সারা জীবন পড়ালেখা করে ভাল ছাত্র ছাত্রীর তকমা লাগানো নিরীহ ছেলেমেয়েগুলো। ক্রমশই দুর্বৃত্তদের নষ্ট হাতের ছোবল বর্ধিত হচ্ছে। একি বিপর্যয় চিকিৎসা সেবায়! আর কত আমাদের নিরীহ ছেলেমেয়েগুলো মার খাবে? মার খাবার জন্যই কি ওরা ছোটবেলা থেকে ভাল্ভাবে পড়াশুনা করে এসেছে? না খেতে পেরে ক্ষুধার যন্ত্রনায় ধুকে ধুকে যে মারা গেল তার জন্য আপনারা কাকে নির্যাতন করছেন? কনকনে শীতে বিবস্র হয়ে খোলা আকাশের নীচে পরে থেকে যে মারা গেল তার জন্য কাকে জেলে পাঠালেন? ঔষধের অভাবে কেউ মারা গেলে তার জন্য দায়ী কে? আপনারা সে চিন্তা না করে জীবন বাঁচাতে হাত পা আর মাথা নিয়ে যে এগিয়ে এল তাকেই ধরে মারছেন। আর এই মার, অসন্মান করা, হাজতে ঢুকানো যেন মহামারী হয়ে গেছে। একেরটা থেকে অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে সবসময়ই মেডিকেল এবং ইঞ্জিনিয়ারিং এ সেরা ছাত্র ছাত্রীরা প্রবেশ করে।বিজ্ঞানের ছাত্র ছাত্রীরা এ দুটি প্রতিষ্ঠানের দরজার কড়া না নেড়ে কিংবা এ দুটিতে চান্স পেয়েও ভার্সিটিতে গেছে এমন সংখ্যা নিতান্তই নগন্য। প্রতি স্কুলের প্রথম সারির (১-১০ কিংবা ১৫) ছেলেমেয়েরাই এখানে আসে। বিশাল এক পড়াশোনার পাহাড় অতিক্রম করে যখন এম, বি, বি, এস পাস করল তখন তাদের পদার্পণ হোল চিকিৎসাশ্বাস্রে।যে পড়াশোনার সাথে অন্য কোন পড়াশোনার তুলনা চলে না। এক অমানুষিক খাটুনির মধ্য দিয়ে যে ট্রেনিংটি তারা পার করে তার জন্য যে মাসোহারা পায় তা আমাদের অশিক্ষিত ড্রাইভার এর বেতনের চেয়েও কম। তার পিছনের সারির বন্ধুটি যখন মোটা বেতনে কোন প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকুরী করে তখন তারা কিছু মনে করে না এই ভেবে যে চিকিৎসকের জীবন একটু আলাদা, যার নির্ধারক বেতন নয়।তারা জানে এ পথ অনেক বন্ধুর ।
ইন্টার্নীর শেষে সরকারী চাকুরী হলে বেতনভুক্ত মেডিকেল অফিসার না হলে অবৈতনিক মেডিকেল অফিসার। সংখ্যায় অবৈতনিক মেডিকেল অফিসার অনেক বেশী।তাই এই অবৈতনিক মেডিকেল অফিসার এবং ইন্টার্নদিয়েই সরকারী হাসপাতালগুলো চলে। বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের কোথাও সন্মানী ছাড়া ট্রেনিং হয় না। কারন ওরাও মানুষ, ওদেরও ভাতের প্রয়োজন, কাপড়ের প্রয়োজন, ওদেরও মা বাবা আছে, দায়িত্ব আছে, কারো সংসার বউ বাচ্চা আছে, ওরা সালোকসংশ্লেসন প্রক্রিয়ায় নিজের খাবার নিজে তৈরী করেনা। তাই নিদারুন অর্থকষ্ট ও টানাপোড়নের মধ্য দিয়ে সকল সামাজিক আনন্দ উৎসব বর্জন করে, জীবনের অনেক সোনালী সময় ফেলে দিয়ে, আত্মীয় স্বজনদের প্রতি দায়িত্ব পালন না করে তাদের প্রত্যাশিত জায়গায় কেউ পৌঁছায় কেউ পৌঁছায়না।চাকুরীর দশ বার বছর পরেও এদের এক এক জনের বেতন মাত্র ২৫ হাজার টাকা। পোস্টগ্রাজুয়েশন ছাড়া এদের কোন প্রোমোশন নেই। এইসব ছেলেমেয়েরা যদি একদিন সরকারী হাসপাতালে কাজ না করে তাহলে হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে।আর তারাই যদি নিরাপদে তার কমর্স্থলে কাজ করতে না পারে, কর্তব্যরত অবস্থায় দুর্বৃত্তদের হাতে মার খায়, সাংবাদিকদের মিথ্যা অপপ্রচারের শিকার হয় তাহলে কেউ কি চিকিৎসক হতে আর আগ্রহী হবে? সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এর প্রতিবাদ করার জন্য সমাজের কোন লোকতো নেই-ই বরং উল্লসিত হতে দেখেছি অনেককে। ডা. সাজিয়া কর্তব্যরত অবস্থায় তার সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে ওয়ার্ড বয়ের মত একটি নিম্নশ্রেনীর মানুষের হাতে নিহত হোল কোনদিন তা গুরুত্বের সাথে খবর হতে দেখলাম না। অথচ সেই একই সময়ে ইন্ডিয়াতে একটি মেডিকেল স্টুডেন্ট রেপড হওয়াতে সারা ভারতবাসী ফুঁসে উঠল।বারডেমে ঘটনা, ডা. পিনু, গোপালগঞ্জ ঘটনা,ডা শাহিন সব কিছুতেই ডাক্তার অকারনে মার খেল সে সত্যি লিখার সাংবাদিক কেউ নেই। অথচ প্রায়মৃত রোগীটি চিকিৎসা চলাকালীন মৃত্যুবরন করলে বিরাট খবর হয়ে আসে ডাক্তারের ভুল চিকিৎসা আর অবহেলায় মৃত্যু বলে। সাংবাদিকদের এই অপপ্রচার এবং মারমুখী এ্যাটেন্ডেন্টদের ঔদ্দ্ব্যত্বের জন্য কোন মানুষকে একটুও প্রতিবাদতো দুরের কথা শুধু কথা বলতেও শোনা যায় না। শোনা যায়না বলেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি জীবন্ত ডা মীমের পোস্টমর্টেম।

কেন ডাক্তারদের প্রতি এই আক্রোস? ডাক্তাররা চাদাবাজী করে? ফাইল আটকে রেখে ঘুষ খায়? সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্য বাড়ায়? শেয়ার বাজার লুট করে? ব্যাঙ্ক ক্রাফটার হয়? দেশবাসীকে ভেজালযুক্ত খাবার খাওয়ায়? কি তাদের অপরাধ? আসুন দেখি তারা কি করে।
এম,বি,বি,এস মানে ছোট ডাক্তার। আপনি কখনও সাধ্য না থাকলেও ওর কাছে যাবেন না। আপনাকে নিখুঁত সেবা দানের জন্য এবং আপনাকে প্রলুব্ধ করার জন্য বড় বড় ডিগ্রী দরকার।আপনাকে উপযুক্ত সেবাটি দেবার জন্য এই বড় ডিগ্রীগুলো নিতে জীবন হয়তো শেষ হয় না কিন্তু অনেকেরই যৌবন শেষ হয়ে যায়। প্রশিক্ষনসহ ৫ থেকে ১০ বছর এমনকি তার বেশিও লেগে যেতে পারে। এই দীর্ঘ সময়ে পরীক্ষা এবং বিভিন্ন কোর্সের ফিস দেওয়ার সামর্থ্যও অনেকের ফুরিয়ে আসে। এই পড়ালেখা এবং পরীক্ষাগুলো যে কি বিভীষিকাময় তা বর্ণনা করার ভাষা আমার কিংবা কারো নেই।শুধু কষ্টের ছাপ রন্ধ্রে রন্ধ্রে লেগে থাকে। পরীক্ষার পদ্ধতি এতই জটীল যে একবার যদি কেউ এ গোলকধাঁধার দুষ্টচক্রে পরে যায় তার জন্য উঠে আসা খুবই মুশকিল। এত মেধাবী ছাত্র ছাত্রী তারপরেও যদি এমন হয় তাহলে সহজেই অনুমেয় যে কি কঠিন পদ্ধতির মধ্য দিয়ে এদের বেরিয়ে আসতে হয়। এত কঠিন বলেই পাশ করতে না পারার হতাশায় আত্মহত্যা করল আদ দ্বীন মেডিকেলের ছাত্রী।
অন্যান্য সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকার ছাত্র ছাত্রীদের যেমন পড়িয়ে থাকে মেডিকেল কলেজেও অনুরূপ পড়িয়ে থাকে। মেডিকেল কলেজে সরকারী বাজেটের বড় একটি অংশ যে বরাদ্দ সেতো হাসপাতালের রোগীদের বিনে পয়সায় চিকিৎসার জন্য। শুধু চিকিৎসা নয় এখানে থাকা খাওয়া দাওয়াও ফ্রী। এই খরচের দায়ভার ছাত্রের ঘাড়ে ফেলে শুধু জনগণের ট্যাক্সের টাকায় এরা ডাক্তার হয়েছে বলে মানুষের অনুভূতিকে নাড়া দেয়া অন্যায় এবং ডাক্তারদের প্রতি অবিচার। বরঞ্চ একজন ডাক্তার তার প্রশিক্ষণের সময় (সি, এ) রাত দিন যে শ্রম দিয়ে সরকারের জনগণকে সেবা দিয়ে থাকে তার বিনিময়ে তাকে সারা জীবন ভাতা দিলেও শোধ হবার নয়। শেখার জন্য যা দরকার তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশী কাজ করে দিতে হয় ব্যস্ত হাসপাতালগুলোতে।

বাংলাদেশে চিকিৎসার সীমাবদ্বতাঃ
সীমাহীন সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে এদেশের ডাক্তারদের ডাক্তারী করতে হয়। পৃথিবীর কোথাও মাটিতে রেখে চিকিৎসা দেবার নিয়ম আছে কিনা জানিনা তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এটি প্রতিদিনের চিত্র। যত রোগী বিছানায় তত রোগী ওয়ার্ডের ও বারান্দার মাটিতে। এই যে রোগীর ঢল তাদের চিকিৎসার জন্য না আছে পর্যাপ্ত ডাক্তার না আছে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সামগ্রী এবং পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। সারা দেশ থেকে এমনকি ঢাকার অন্যান্য হাসপাতালগুলো থেকে মরনাপন্ন রোগীগুলোকে এখানে রেফার করা হয়। তাদের ম্যানেজ করার জন্য চিকিৎসককে সাহায্য করার মত দক্ষ এবং দায়িত্বশীল লোকবল এবং চিকিৎসা সামগ্রী যথেষ্ঠ নেই। চিকিৎসকের কাজ ব্যবস্থা পত্র দেয়া। সেগুলো ফলো করা রোগীর সুবিধা অসুবিধা পর্যবেক্ষণ করা নার্সদের কাজ। ঔষধপত্র, স্যালাইন, অপারেশন সামগ্রী এগুলো সাপ্লাই দেয়া প্রশাসনের কাজ। কিন্তু সরকারী হাসপাতালে বহু চিকিৎসক ব্যক্তিগত ভাবে ঔষধ, রক্ত যোগানতো দিয়েই থাকে ইমারজেন্সির সময় ট্রলিটি ঠেলে নিতেও কেউ কুন্ঠাবোধ করেনা। চিকিৎসা একটি টীম ওয়ার্ক। এই টীমের বড় রিংটি চিকিৎসক। কিন্তু বাকীরা (নার্স ও অন্যান্যরা, প্যাথলজিকাল কার্যক্রম এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা) যদি সেই চেইনের কার্যকারিতার ব্যাঘাত ঘটায় তার সর্বশেষ প্রভাব পরে রোগীর উপর। যার দায়বদ্ধতা এসে পরে চিকিৎসকের উপর।কারন সবাই ফলাফল চায় তার পিছনের কাহিনী কেউ শুনতে চায় না।

চিকিৎসায় দুর্নীতি
চিকিৎসায় দুর্নীতি অমার্জনীয় অপরাধ। ডাক্তার যদি দুর্নীতিগ্রস্থ হয়, কারো অবহেলায় কোন রোগী মারা যায় বা মারাত্তক ক্ষতিগ্রস্থ হয় এসবের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন প্রমান পাওয়া গেলে যথাযোগ্য শাস্তি এবং ক্ষতিপূরন অনেক কিছুই অবশ্যই হতে পারে। কিন্তু সেটি বিচারের ভারতো সাংবাদিকের নয়। মৃত্যু পথযাত্রী কোন রোগীকে বাঁচাবার ক্ষমতা কি আল্লাহ কাউকে দিয়েছেন? চিকিৎসক চেষ্টার সবটুকু ঢেলে দিয়েও সবসময় মানুষকে বাঁচাতে পারে না। তাহলেতো মানুষ অমর থেকে যেত। মানুষতো মরবেই।একজন মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচিয়ে তোলার যে কি আনন্দ তা ঐ ডাক্তার ছাড়া কেউ বুঝবেনা। সেটা যে রোগীর স্বজনদের আনন্দের চেয়ে কোন অংশে কম নয় এটি সবাইকে বুঝতে হবে। রোগীর মৃত্যুতে ডাক্তারের চোখেও পানি আসে। রোগীর জন্য যদি কারো দরদ থাকে তা স্বজনদের পরে চিকিৎসকদের, কোন তৃতীয় পক্ষের নয় এটা বুঝতে হবে। দিনের পর দিন কত মুমূর্ষু রোগীকে জীবনে ফিরিয়ে আনছে কত চিকিৎসক। নিজের পকেটের পয়সা দিয়ে বাঁচিয়ে তুলছে কত রোগীর জীবন।কারন চিকিৎসকের নিজের জীবনের সফলতা তার রোগীর সুস্থতা।প্রত্যেকের মৃত্যু পূর্বনির্ধারিত আর এই মৃত্যুর জন্য স্বজনরা চিকিৎসকদের মারবে জেল হাজতে পাঠাবে এ কেমন পাশবিকতা ! সারা জীবন ভাল ছাত্রের তকমা গায়ে লাগিয়ে যে ছেলেটি বা মেয়েটি এতদূর এল, কর্মজীবনের শুরুতেই সে কিনা মার খেল রাস্তার সন্ত্রাসীদের হাতে। এটাই কি সেই সন্মানজনক পেশা? সব লুন্ঠিত হতে হতে মানুষের সন্মানও আজ লুন্ঠন হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবাদের বা প্রতিকারের কেউ নেই। আত্মসন্মান বাঁচাতে মানুষ পরিবেশ এড়িয়ে চলে । তা’হলে কি চিকিৎসকরা সরে দাঁড়াবে এ পেশা থেকে? এই অসুস্থ পরিবেশ থেকে? নবীন চিকিৎসকরা এরই মধ্যে চিন্তা করছে সরে দাড়াবার, হয় পেশা বদলাবে নয় বিদেশে পাড়ি দেবে। কি হবে তাহলে এদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার!!!!!


>collected<