Wednesday, September 28, 2016

আমাদের ভারতপ্রীতি ও হে বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন


প্লট-১(#পিঁপড়ার_দল)

ওয়াইফ MRCPCH(UK) পরীক্ষা দিবে, এক্সাম সেন্টার হয় কোলকাতা অথবা মুম্বাই বা চেন্নাই।ভিসা সংক্রান্ত কাজ কমপ্লিট করার জন্য মতিঝিলের #State_Bank_of_India তে গেলাম।সিরিয়ালে আটকা পড়লাম, আমার আগে আরও প্রায় ১৫ জন লোক।সিরিয়ালে আমার সামনে থাকা লোকের সাথে টুকটাক কথা বলে সময় পার করছি ।

কথায় কথায় জানলাম উনিও উনার ওয়াইফকে নিয়ে ইন্ডিয়া যাচ্ছেন, ওয়াইফ Ankylosing Spondylitis( এক ধরণের বাতব্যাথা রোগ) এ আক্রান্ত।আমি একটু আমতা আমতা করে বললাম,'ইন্ডিয়া যাচ্ছেন কেন? যতদূর জানি এর চিকিৎসা তো এদেশেই হয়, আমার মামাতো ভাইতো এদেশেই চিকিৎসা নিচ্ছে'।

উনি বলে উঠলেন, "দূর, দূর, আর বইলেন না, এদেশের ডাক্তাররা কিছু জানে নাকি! সব মূর্খের দল।দেখেন না, আমার সামনের জন সেও চিকিৎসার জন্য ইন্ডিয়া যাইতেছে"।তার সামনের ভদ্রলোক মাথা নেড়ে এই কথায় সায় দিলেন, যতটুকু বুঝলাম Hepatitis B virus carrier, এর পারফেক্ট চিকিৎসা এদেশেই আছে, তারপরও যাচ্ছেন।এবার সে লোকের কথায় জানলাম তার সামনের লোকও চিকিৎসার জন্য ইন্ডিয়া যাচ্ছে, আমি ভিমরী খেলাম।

আমি মোটামুটি নিশ্চিত হলাম, আমার সামনের ১৫ জনের মধ্যে মিনিমাম অর্ধেক চিকিৎসার জন্য ইন্ডিয়া যাচ্ছেন।আমি এদের সাথে আংশিক কথাবার্তায় এটাও নিশ্চিত হলাম এদের অধিকাংশের চিকিৎসা এদেশেই সম্ভব ছিলো।

আমার সামনের জন আমি কেন ইন্ডিয়া যাচ্ছি তা জানতে চাইলেন।এই দেশের ডাক্তারদের যে লোক একটানে মূর্খ বলে রায় দেয়, তার কাছে কিভাবে বলি যে চিকিৎসা বিদ্যার উচ্চশিক্ষার জন্যই আমার এই মুভমেন্ট।মূল ঘটনা চাপা দিয়ে বললাম, 'ঘুরতে যাচ্ছি'।এবার ভদ্রলোকের চোখ চকচক করে উঠলো, বললো, "যান, যান, ঘুইরা আসেন, আহাহা! কি সুন্দর দেশ ! কয়েকবার গেছি।কোন কোন জায়গায় ঘুরবেন, সেইটা একটু বলি......"


প্লট-২(#ঝড়ে_বক_মরে)

আম্মু ESRD (#Irreversible, দীর্ঘমেয়াদী কিডনী জটিলতার শেষ পর্যায়) এর পেশেন্ট।আমার আত্মীয় সজনের বধ্যমূল ধারণা আম্মুকে ইন্ডিয়া নিয়ে গেলে উনি সুস্থ হয়ে যাবেন, আমি অবহেলা করে নিচ্ছিনা।একজন তো মা'র সামনেই বলে ফেললেন, "ছেলেটা আপনেরে ইন্ডিয়া নিলে বাঁইচা যাইতেন।সঠিক শিক্ষা দেন নাই, তাই বাপ-মায়ের দিকে নজর কম"।

বার বার বললে অসত্য তথ্যও সত্যের মত শোনায়। বাইরের লোকদের কথায় একসময় আম্মু মোটিভেটেড হলেন, বললেন, 'ইসহাক সাহেবেরও তো #ক্রিয়েটিনিন(এক ধরণের কিডনী ফাংশন মার্কার) ১২ ছিলো, ইন্ডিয়া গিয়ে ভালো হইছে।আমারে একটু ইন্ডিয়া নিয়ে দেখবি?' আমি বিরক্ত হলাম, বললাম, 'বাইরের লোকের কথা বিশ্বাস কর, আর আমার উপর বিশ্বাস নাই? ঠিক আছে, ইসহাক সাহেবকে কাগজপত্র নিয়া আসতে বল, দেখি ইন্ডিয়া কি ম্যাজিক দেখাইছে'।

ইসহাক সাহেবের কাগজপত্র আসলো।যা ভেবেছিলাম তাই--উনার ডায়াগনোসিস ছিল AKI( এক ধরণের #Reversible কিডনী ইনজুরী), Proper চিকিৎসা পেলে উনি এদেশেও ভালো হতেন।Reversible এই রোগের নামকাওয়াস্তে চিকিৎসা দিয়ে ইন্ডিয়ান ডাক্তরারা পার্টটা ভালোই নিয়েছে, --'কেউ পারতো না, যা ব্যাটা, তোরে ভালো কইরা দিলাম'।--"ঝড়ে বক মরে, হুজুরের কেরামতি বাড়ে"--কথাটা জানতাম, ঐদিন নিজ চোখে ইন্ডিয়ার হুজুরদের কেরামতি দেখলাম।


প্লট-৩(#বাটপারী_ওভারলোডেড)

আমি যে জায়গায় পেশেন্ট দেখি সে জায়গাটা হিন্দু অধ্যুষিত, কিছু হলেই এখানকার রোগীদের একটা বড় অংশ ইন্ডিয়া ছোটে।

চেম্বারে রোগী দেখছিলাম।রোগী ঠিকমত হাটতে পারে না।ইন্ডিয়াতে গিয়েছিলো, কাগজপত্র দেখলাম। মিনিমাম ৫০ টা পরীক্ষা, আই রিপিট, মিনিমাম ৫০ টা ইনভেস্টিগেশন করানো, Serum Trypsin লেভেলও করা।রোগী হাটতে না পারার সাথে Serum Trypsin লেভেলের ইহকালে বা পরকালে কোন সম্পর্ক আছে বা থাকতে পারে বলে আমার জানা নেই।
ক্লিনিক্যাল এক্সামিনেশন শেষে প্রেসক্রিপশনে ডায়াগনোসিস #CIDP( এক ধরণের নার্ভের রোগ) লিখে রোগীকে পরবর্তী চিকিৎসার জন্য আগারগাঁ Neuroscience Institute এ রেফার করলাম।

এতক্ষণ পরে চোখে পরলো, রোগীর স্ত্রী যক্ষের ধনের মত কি একটা যেন হাতের মধ্যে আগলে রেখেছেন।এক্সপ্লোর করে দেখি রোগীকে প্রেসক্রাইব করা ইন্ডিয়ান মাল্টিভিটামিন।৫০ পরীক্ষা শেষে মাল্টিভিটামিন!!! বাটপারির একটা সীমা থাকা উচিত--ভারতীয় মুভির একটা ডায়ালগ মনে পড়ে গেল--"ইন্ডিয়া, তুসি গ্রেট হো!"


প্লট-৪(#ইন্ডিয়ান_রামধরা)
 
এবারের কাহিনী কিংবদন্তী এক নিউরোলজিস্ট স্যারের,ঘটনাটা অনেক ডাক্তারই জানেন।এক আমলা নিউরোলজিস্ট স্যারের কাছে রোগী হিসেবে এলে স্যার ক্লিনিক্যালি ডায়াগনোসিস করলেন #GBS( এক ধরণের নার্ভের সমস্যা)।
আমলা সাহেবের তাতে মন ভরলো না।আমলা সাহেব ইন্ডিয়াতে গিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করবার পর তাকে জানানো হলো তার রোগ-GBS...." নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস,ওপারেতে সর্ব সুখ আমার বিশ্বাস"...আমলা সাহেব ওপারের সুখের স্বাদ নিতে গিয়ে রামধরা খেলেন.....


#Bangladesh_vs_India
 
(হায়রে কপাল মন্দ, চোখ থাকিতে অন্ধ)
World Health Organization(WHO) ২০১৬ সালে Health Sector এর সামগ্রিক দিক বিবেচনা করে যে ১৯০ টি দেশের World Ranking প্রকাশ করে সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৮ তম।ইন্ডিয়ার পজিশনটা জানা আছে?--১১২ তম(Screenshot কমেন্টে)।WHO এর কর্তাব্যক্তিরা ঘাস খেয়ে এই Ranking তৈরি করে নাই। এই Ranking দেখার পরও ইন্ডিয়াতে গণহারে যারা চিকিৎসার জন্য যান, তাদেরকে দেখে একটা কথাই আমার মাথায় ঘোরে-'#হায়রে_কপাল_মন্দ, #চোখ_থাকিতে_অন্ধ....'

ভারতের #নোবেল_বিজয়ী অর্থনীতিবিদ #অমর্ত্য_সেনের কথাগুলো হুবহু তুলে ধরি, “ভারত অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে থাকলেও তারা স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সংক্রান্ত সূচকে বাংলাদেশের তুলনায় অত্যন্ত পিছিয়ে।........ভারত স্বাস্থ্য সমস্যাকে জটিল করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এটি হয়নি। বাংলাদেশ গত এক দশকে এই খাতে ভাল উন্নতি করেছে।....... ভারতের মাথাপিছু জিডিপি বাংলাদেশের দ্বিগুণ, কিন্তু বাংলাদেশের গড় আয়ু ভারতের চেয়ে বেশি।”

যে কথা ভারতের সজ্জন ব্যক্তিরা স্বীকার করেন, জানেন ও বোঝেন, জাতিগতভাবে বেশী বুঝদার বাঙালীর সেটা বুঝতে সমস্যা হয়।যে দেশে এখনও millions of people- Open air defecation( সোজা বাংলায় -খোলা ময়দানে মলমূত্রত্যাগ) করে, আমাদের দেশের একশ্রেণীর লোক সেদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে আনন্দিত হয়, তৃপ্তির ঢেকুর তোলে।ভালোই.....

যে দেশের অবস্থান WHO ranking এ ইন্ডিয়ার আগে, যে দেশের বিশেষজ্ঞরা খোদ ভারতে গিয়ে ভারতকে দ্বিতীয় বানিয়ে নিজেরা প্রতিযোগীতায় প্রথম হয়(APLAR আয়োজিত প্রতিযোগিতায়), যে দেশে Kidney transplant এ নবদিগন্ত রচিত হচ্ছে, যে দেশের চিকিৎসকরা Tree man syndrome( Epidermodysplasia verruciformis) নামক rarest রোগের চোখধাঁধানো অপারেশনের নেতৃত্ব দেয়, যে দেশের চিকিৎসকরা মাতৃগর্ভে গুলি খাওয়া শিশুকে তাদের প্রজ্ঞা ও ধী-শক্তির সহায়তায় আবার তার মায়ের কোলে ফিরে যাওয়াকে নিশ্চিত করে--সে দেশ থেকে চিকিৎসার জন্য পিপীলিকার মত লোক ইন্ডিয়াতে কেন যায়?


#কারণগুলো_কিন্তু_পরিষ্কারঃ


১. #কাউন্সেলিং_এর_অভাবঃ আমি জানি, এদেশের চিকিৎসকরা রোগ ধরতে যথেষ্ঠ পারদর্শী, কিন্তু ৫ মিনিট রোগীর সাথে রোগ নিয়ে কথা বলতে তাদের বাঁধে।এ সুযোগটাই ইন্ডিয়া নেয়।ওপার বাংলায় যাওয়া মাত্রই "ওপার থেকে দাদা এসেছেন" বলে হাত ধরে তারা যখন আমাদের দেশের রোগীকে হাসপাতালে ঢোকান, তখন এই বাঙালির নরম হৃদয় আবেগে আপ্লুত হয়। ভুলেও এই বাঙালি বুঝতে পারে না যে "দাদা, দাদা" বলে ওনারা অলরেডী গাছের গোড়া কাটা শুরু করেছেন....

২.#পেইড_মিডিয়াঃ এটাও কি বলে দিতে হবে যে কোন্ কোন্ মিডিয়া এই পেইড দলের অন্তর্ভুক্ত? যদি ধরতে না পারেন তবে epic fantasy novel series-- "A Song of Ice and Fire" এর একটি ডায়ালগ মনে করিয়ে দেই- "You know nothing, Jon Snow".....

৩.#পেইড_এজেন্টঃ ইন্ডিয়ায় পোষ্ট গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হয় ৩ বছরে, যেখানে আমাদের দেশে লাগে ৫ বছর।৩ বছরে তৈরি হওয়া এই দুর্বল বিশেষজ্ঞের কিছু অংশ নিজ দেশে ভাত না পেয়ে আমাদের দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দুর্বলতায় এদেশে আসন গাড়ে।হাজার হাজার টাকা ভিজিট নিয়ে একসময় বলে পরবর্তী চিকিৎসা হবে ইন্ডিয়ায়, ইন্ডিয়ার ভিজিটিং কার্ডটাও ধরিয়ে দেয়।কি বিশ্বাস হয় না? লিঙ্ক লাগলে বলবেন, খবরটা ধরিয়ে দেব।

একটা কথা না বললেই নয়--এই পেইড মিডিয়া ও পেইড এজেন্টের জন্যই আজ বাংলাদেশে Kidney Transplant বন্ধ হবার দশা, কিছু চিকিৎসকদের অনৈতিকতাও দায়ী।ইন্ডিয়াতে গেলে এই অপারেশনের খরচ পড়ে ১৫-২০ লাখ টাকা, এর ঝুটা একটা অংশ এই পেইড মিডিয়া ও এজেন্ট পায়।বাংলাদেশে এই অপারেশন শুরু হবার পর "ঝুটা" বন্ধ হবার উপক্রম হলো, কাজেই প্ল্যান করে Kidney Transplant বন্ধ করা হলো।বাংলাদেশে এই অপারেশনের খরচ পড়তো ২ লাখ টাকা।নিজ দেশের হাজার হাজার লোকের জীবন তো বাঁচতোই, কম খরচের জন্য এসব দক্ষ চিকিৎসকদের কাছে দেশের বাইরে থেকেও রোগী আসারও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিলো।এদেশের টাকা এদেশে থাকার সাথে সাথে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এ খাতটি এখন ধংসপ্রায়।


৪.#সংশ্লিষ্ট_কর্তৃপক্ষের_আশ্চর্যজনক_নীরবতাঃ পেইড মিডিয়া ও পেইড এজেন্টের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সন্দেহজনকভাবে নীরব। নীরবতার কারণটা কি?


৫.সাধারণ জনগণের #তুলনামূলক_তথ্যর_অভাবঃ তুলনামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভালো নাকি ইন্ডিয়া ভালো -সে তথ্য সাধারণ জনগণের অজানা।এ ব্যাপারে তারা নির্ভর করে আরেক সাধারণ লোকের মনগড়া তথ্যকে।চায়ের দোকানদারও চা-বানাতে বানাতে বলে," ইন্ডিয়ার চিকিৎসার উপ্রে কিছু নাই"....আমরা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলি, "কথাডা মিছা না, কথা সত্য"।

৬.#আমি_তো_এমনি_এমনি_যাইঃ হরলিক্সের একটা বিজ্ঞাপনে এক বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো সে কেন হরলিক্স খায়? উত্তরটি ছিলো--" আমি তো এমনি এমনি খাই"....ঠিক তেমনি কিছু লোককে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, 'চিকিৎসার জন্য ইন্ডিয়া কেন যান?' উত্তর -"আমি তো এমনি এমনি যাই, ভালো লাগে"।এ গর্দভকুলের সংখ্যা কম নয়।


#পরিশেষ

"হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;—
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি, পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ...... "
স্পেসিফিক কিছু ডিজিজের সমাধানে ইন্ডিয়া এই দেশ থেকে বেটার হতে পারে, এ কথা অস্বীকার করি না।কিন্তু তা বলে ঢালাও ভাবে এদেশ থেকে চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়া যুক্তিহীন। এ ধরণের উদ্ভট কর্মকান্ড নিজের দেশপ্রেমকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, নিজের মূর্খতাকে উন্মোচিত করে। আমি জানি বাংলাদেশ এখনও চিকিৎসা শাস্ত্রে কাঙ্খিত অর্জন থেকে দূরে আছে।কিন্তু ইন্ডিয়া তার বিকল্প নয়।এই বঙ্গ-ভান্ডারে অনেক চিকিৎসক রত্ন রয়েছেন।তাদের উপর আস্থা রাখুন, তাদের সেবা নিন।দেশের কারেন্সি দেশেই রাখুন, দেশকে সমৃদ্ধ করুন.....


কার্টেসি- ডা: জামান অ্যালেক্স

Wednesday, September 21, 2016

রোগীরা এভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়লে তো এমন হবেই।

যে ডাক্তার প্রতিদিন ৮০-১০০ জন রোগী দেখেন , রোগীরা তাঁকে দেখানোর জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এমনকি ওই ডাক্তারের ভিজিট ফি ৮০০ টাকা হলে, তাঁকে দেখানোর জন্য তাঁর পিওনকে ১০০০ টাকা ঘুষ দিয়ে হলেও দেখাতে চেস্টা করে! এতে করে ওই ডাক্তার রোগীদেরকে ঠিকমতো সময় দিতে পারেন না। ঠিকমতো সময় দিতে হলে রোগীকে ৩০ দিন পরে আসতে বলা হয়! ততদিনে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। রোগীরা এভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়লে তো এমন হবেই, তাই না?

 অন্যদিকে একই রকম যোগ্যতার এবং সচ্চরিত্রবান অন্য অনেক ডাক্তার তাদের চেম্বারে খালি বসে থাকেন বা বড় জোর ৫ -৬ জন রোগী দেখেন!

আমি আমার কোন আত্মীয় স্বজনকে কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে হলে যে ডাক্তারের চেম্বারে রোগী কম সেই ডাক্তারকে দেখাই।

তাছাড়া নিজে নিয়ত করেছি, ভবিষ্যতে আল্লাহ কোনদিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হওয়ার সুযোগ দিলে (আল্লাহর রহমতে সে পথেই আছি) রোগীকে অত্যানুকুল সময় দিয়ে প্রতিদিন যে কয়জন সম্ভব , তার চেয়ে বেশি রোগী দেখবোনা।
কেননা আমার সমান বা বেশি যোগ্যতা বিশিষ্ট আমার সহকর্মীর অভাব নেই সারা দেশে । অন্য রোগীরা আমার অন্য সব সহকর্মীদের কাছে যাক। কারন বিবেক আর রিজিক বলে একটা কথা আছে।

আর কোন রোগীকে কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে হলে বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া আমি সদ্য পাস করা ডাক্তারদের কাছেই পাঠাতে চেস্টা করি;
 কেননা (১) মাছি মারতে কামান দাগা লাগে না, এবং
 (২) এই ডাক্তারের আত্মীয়-স্বজন এবং পরিবারের সদস্যরা অনেক দিন ধরে আর্থিক সহযোগিতা পাওয়ার আশায় বসে আছে।

লেখক > ডাঃ মোঃ মাকসুদ উল্লাহ

Monday, September 19, 2016

একটি মেধাবী পেশাগত শ্রেণী

সম্পদে ও সম্ভাবনায় ভরপুর আমাদের প্রিয় দেশ আজ থেকে ৪৬ বছর আগে একটি সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীন হলেও স্বাধীনতার পূর্ণ স্বাদ আমরা আস্বাদন করতে পারছি না। দেশ কাঙ্ক্ষিত গতিতে এগুতে পারছে না। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে নানা রাজনৈতিক সঙ্কট তো আছেই, এর সাথে যোগসাজশ আছে এদেশের শিক্ষিত মানুষদের একাংশের তৈরি আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার। আমলাতন্ত্রের চরিত্র নির্ধারণ করার কথা সংশ্লিষ্ট সমাজের। কিন্তু বাংলাদেশে আমলাতন্ত্রই যেন সমাজ ও রাজনীতির চরিত্র নির্ধারণ করতে চলেছে! আমলাতন্ত্রের কোন কোন অংশ আজ এতটাই আধিপত্যবাদী হয়ে উঠেছে যে স্বাস্থ্যের মত মহা জনগুরুত্বপূর্ণ খাতেও নানা খাদ এবং খুঁত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দাফতরিক আমলাতন্ত্র যখন একটি  দেশের ক্ষমতা, মর্যাদা আর সুযোগ সুবিধার স্থায়ী কেন্দ্র হয়ে যায়, তখন সমাজের মেধাবী মানুষগুলোর একটা বিরাট অংশ যথাযথ রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক মূল্যায়ন পান না। তেমনি একটি মেধাবী পেশাগত শ্রেণী হচ্ছে সরকারী ডাক্তাররা। সবচেয়ে মেধাবী হয়েও যারা এই রাষ্ট্রের সবচেয়ে কম সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন চাকরি করে থাকেন তারা হলেন এদেশের সরকারী ডাক্তারগণ।

একটি জাতির অন্যতম দরকারি মানব সম্পদ হচ্ছে চিকিৎসকগণ। দুর্বল স্বাস্থ্যের জনতা দিয়ে কোন জাতি উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারেনি। জনতার শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য ভাল রেখে একটি উৎপাদনশীল জাতি যারা নির্মাণ করবেন সেই ডাক্তারদের যারা সিভিল সার্ভিসে আসেন তাঁদেরকে রাষ্ট্র এবং সমাজ কী হালতে রেখেছে তা নিয়ে আজকের আমার এই লেখা। একজন পড়তে-লিখতে জানা নাগরিক হিসেবে আমি যা প্রত্যক্ষ করেছি, যা জেনেছি, অনুধাবন করেছি তার উপর ভিত্তি করে এই লেখা।

যারা ডাক্তার হিসেবে সিভিল সার্ভিসে আসেন তাঁদের অভিজ্ঞতা, সুবিধা-অসুবিধা অন্য কোন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সাথে মেলেনা। ডাক্তারদের অবস্থা দেখে বোধ করি স্বয়ং ঈশ্বরও দেশের রাজনীতি ও জনপ্রশাসনের মুন্সিয়ানায় (!) অবাক না হয়ে পারেন না। এই ডাক্তাররা চাকুরীতে জয়েন করার আগের জীবন এবং  পরের জীবন কোনভাবেই মেলাতে পারেননা। বিশেষ করে সদ্য এমবিবিএস পাশ করা মেডিক্যাল স্টুডেন্টরা বিসিএসে জয়েন করার আগে কল্পনাও করতে পারেননা সামনের দিনগুলোতে জীবন কতবার, কীভাবে রঙ পালটাবে!

স্কুলের যে ছেলে/মেয়েরা ট্র্যাডিশনালি সবচেয়ে মেধাবী তাদেরকে বিজ্ঞান শাখায় পড়াশুনার জন্য অভিভাবক এবং শিক্ষকরা বেছে নেন। অঙ্ক, বিজ্ঞান, সমাজ, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে বেশি পারদর্শী হন বলেই এরা অন্যদের তুলনায় মেধাবী বলে বিবেচিত হন। সবচেয়ে মেধাবীদের মধ্য থেকে অনেকে ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার হন। বিজ্ঞান ভালো বুঝেন এমন কেউ যদি সাহিত্য বা সিনেমা-নাটকেও আসেন তাহলে কীরকম সৃজনশীল এবং উৎপাদনশীল হতে পারেন বাঙ্গালীর জগতে তাঁর বড় উদাহরণ তো আমাদের দেশের হুমায়ূন আহমেদই আছেন। যাইহোক মূলকথায় আসি। এই সবচেয়ে মেধাবীরা যতদিন পড়াশুনা করেন ঠিক আছে, কিন্তু যখনি সরকারি চাকুরীতে আসেন শুরু হয় দুর্গতি। এ লেখায় ফরেন ক্যাডাররা আলোচনায় আসবেন না। কারণ তাঁদের কাজের ধরণ এবং ধারণা এমনি এলিট যে ঢাকায় সদর দফতরে অফিস করেও ওনাদের মন খারাপ থাকে। ইউরোপ এবং মার্কিন মুল্লুকে পোস্টিং পাওয়াকেই এখানে ভালো পোস্টিং হিসেবে ভাবা হয় ।ফলে আমার আলোচনা ঘুরপাক খাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যারা কাজ করছেন তাদেরকে নিয়ে। জুডিশিয়াল সার্ভিসে আসার পরীক্ষা-পদ্ধতি ভিন্ন হলেও এ সার্ভিসের অফিসাররাও এ আলোচনায় আসবেন।

জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ বা তথ্য কর্মকর্তার পোস্টিং হয় জেলা লেভেলে; নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের পোস্টিং হয় উপজিলা লেভেলে। প্রকৌশলীদের পোস্টিংও হয় উপজিলা লেভেলে। সবার জন্য গোছানো অফিস থাকে; যার যার কর্মচারীর বহর থাকে। বিশেষ করে জুডিশিয়াল ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের এবং পুলিশ কর্মকর্তাদের অফিস স্ট্যাটাস আর স্টাইলের সাথে বাকিদের কোনভাবেই মেলানো যায়না। অফিসিয়াল নিরাপত্তা, খেদমতে ওস্তাদ কর্মচারী বাহিনী, সন্ধ্যা হলে টেনিস কোর্ট, গাড়ি, জনমানুষে এবং জনমানসে অবতার-সম ‘শ্রদ্ধা’ অথবা ‘ভয়’- কী নেই এই মহামহিমদের জীবনে!   
 
এই প্রশাসনিক অভিজাতদের সাথে সরকারি ডাক্তারদের জীবন একটু মিলিয়ে দেখুন। অনেক সরকারি ডাক্তার চাকুরী জীবনের প্রথম দু বছর যেসব জায়গায় পোস্টিং পান, যে ধরণের স্থাপনায় বসে অফিস করেন, সেখানে একজন এএসপি/জুডিশিয়াল/নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এর জীবনে গাড়ি নিয়ে ঘুরতেও যাওয়ার কথা না। অনেক জায়গায় গাড়ি নিয়ে যেতেও পারবেন না। কারণ রাস্তা নাই। অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরও সেখানে যাওয়ার কথা না। ইউনিয়ন লেভেলে কমিউনিটি ক্লিনিক কিংবা সাব-সেন্টারে অফিস থাকে সিভিল সার্ভিসে আসা ডাক্তারদের। এসব অফিসের অনেকগুলোতে আবার  আসবাবপত্র থাকে ভাঙ্গাচোরা। তিনপেয়ে চেয়ার আর ভাঙ্গা গ্রিলের জানালা এসবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অনেক  ক্ষেত্রে অফিসে বিদ্যুৎ থাকেনা। যেখানে অফিস থাকে সে এলাকায় গ্যাস নাই, ইন্টারনেট নাই, হোটেল নাই, রেস্টুরেন্ট নাই, পার্ক, খেলার মাঠ কিছুই নাই। সাব-সেন্টারের সবকিছুর ‘মালিক’ থাকেন একজন ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার ভিজিটর (এফডব্লিউভি) নামে পরিচিত একজন সরকারি স্বাস্থ্যকর্মী যার সাথে এই ডাক্তারদের অফিস শেয়ার করতে হয়।

এফডব্লিউভিরা আবার স্বামী-স্ত্রী নিয়ে সাব-সেন্টারের উপরেই বসবাস করেন। তদুপরি, এই এফডব্লিউভিরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন কেউ নন।ইনারা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের আওতাধীন। ফলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিসিএস কর্মকর্তা হিসেবে একজন ডাক্তার এফডব্লিউভিকে কোন কিছুর জন্য অধিকার বা নিয়ন্ত্রন নিয়ে কিছু বলবেন, সে সুযোগ থাকেনা বললেই চলে। আর অব্যবস্থাপনা দেখে ডাক্তার যদি কোন কিছুর শেকায়েত করেও বসেন সবসময় তার মনোলোভা উত্তর পাবেন তার নিশ্চয়তা নাই। অথচ, একজন এফডব্লিউভি আমলাতান্ত্রিক হিসেবে সম্ভবত তৃতীয়/দ্বিতীয় শ্রেণীর একজন কর্মচারী।

কী পরিমাণ কষ্ট করে, সময় ব্যয় করে একজন ডাক্তার তাঁর কর্মস্থলে পৌঁছান স্বচক্ষে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে বলে আমার বিশ্বাস হয়না। এমন জায়গায় অনেকে পোস্টিং পান যেখানে শুধু হেলিকপ্টারে গিয়ে প্যারাসুট দিয়ে নেমে অফিস করে আবার হেলিকপ্টারে করে ফিরে আসা যাবে। সরকারি কোন ট্রান্সপোর্ট সুবিধা থাকেনা। হয় হেঁটে অফিসে যান, নতুবা সারাদিনের জন্য রিক্সা ভাড়া করে নিন। অনেক জায়গা আছে যেখানে যেতে হলে নৌকা ছাড়া যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। হবিগঞ্জের আজমিরিগঞ্জ কিংবা শেরপুরের ঝিনাইগাতির পাহাড় আর জঙ্গলে যাদের পোস্টিং হয় তারা আমার কথাগুলো ভালো অনুধাবন করতে পারবেন।
শেরপুরের পাহাড়ের কোলে যেখানে গোধূলির সাথে নেমে আসে বুনো হাতির পাল কিংবা আরেকটু অন্ধকারে ‘ক্রান্তিকারি’দের দল, সেখানে পোস্টিং হয়েছিল আমার পরিচিত এক প্রেমিক সাংবাদিকের সদ্য মা হওয়া স্ত্রীর। ৫/৬ মাসের নবজাতককে নিয়ে সেই ডাক্তার মা না-জানি কীভাবে বিদ্যুৎবিহীন একেকটা রাত পার করেছিলেন! জীবনে প্রথমবারের মত বাবা হওয়া সেই সাংবাদিককে তখন দেখেছি ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে ঢাকায় কাজ করে যেতে। অন্য কোন ক্যাডারের কর্মকর্তা পারবেন ঐ জঙ্গলের মধ্যে এভাবে একা থেকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করতে? সার্কিট হাউজের এসি রুমে বসে বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’ পড়ে হলিডে উদযাপনের পরিকল্পনা করা আর ঝি ঝি পোকা আর শিয়ালের পিলে চমকে দেয়া ডাকসমেত বসবাস করে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করা এক জিনিস নয়।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের দাফতরিক এবং অবস্থানগত অবস্থা প্রায় একইরকম। সাধারণত কর্মকর্তারা যেখানে অফিস করেন সেখানে, বা তার আশেপাশে সরকারি থাকার বন্দোবস্ত থাকে। অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য থাকেও। উপজেলা লেভেলে থানার ওসি কিংবা এসিল্যান্ডের ভালো থাকার জায়গা নেই একথা কেউ বলবেনা, বললে বিশ্বাসও করবেনা। জেলা লেভেলে তো নির্বাহী/জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, এএসপিরা বেশ ভালো জায়গায় থাকেন। আর সরকারি সব থাকার জায়গাতো প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দখলেই থাকে। তারা যাকে যতক্ষণ থাকতে দেন ততক্ষণই থাকা যায় সেগুলোতে। নতুন যারা বিসিএস ক্যাডার হিসেবে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যোগদান করেন তাঁদের কোন ধরনের সরকারি থাকার ব্যবস্থা থাকেনা। উপজেলা/জেলা লেভেলের হাসপাতালের কিছু কোয়ার্টার থাকে কিন্তু সেগুলো আগে থেকেই সিনিয়র সরকারি ডাক্তারদের দ্বারা ফিল-আপ থাকে। আর ইউনিয়ন লেভেলে সরকারের ব্যবস্থায় থাকার কিছু আছে বলে আমার জানা নেই। একটা ছেলে তাও লজিং মাস্টারের মত গ্রামের মেম্বার বা চেয়ারম্যানের বাসায় থাকার ব্যবস্থা করতে পারলেও মেয়েদের জন্য কি এটা সম্ভব?

আমাদের প্রশাসনিক অভিজাতরা কাদেরকে সেবা দেন? এএসপি বা এসপি দূরের কথা, সাধারণ মানুষ একজন ওসির কাছেই কি খুব সহজে পৌঁছাতে পারেন? বিচারকদের কাছেতো আমাদের মত উচ্চশিক্ষিত মানুষই কথা বলা বা যোগাযোগ করার আগে একশবার ভেবে কথা বলেন। অন্যভাবে কথাটা বলা যায়। সাধারণ মানুষের তো প্রতিদিন প্রতিনিয়ত পুলিশ কিংবা বিচারকের কাছে যাওয়ার দরকারও পড়েনা। অনেক মানুষ আছে বাংলাদেশে যারা জীবনে একবারের জন্য হলেও থানায় কিংবা আদালতে যাননি। দেশে নানামাত্রায় এবং প্রকৃতিতে অপরাধ প্রবণতা থাকেলও আমাদের সমাজব্যবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনো বেশ শক্তিশালী। সাম্প্রতিককালে দেশে জঙ্গিবাদী তৎপরতা থামাতে পুলিশ, র‌্যাব বেশ পরিশ্রম করছেন, শহীদ হচ্ছেন এটা সত্যি। আবার এটাও সত্যি যে, মুষ্টিমেয় কিছু অপরাধী বাদ দিলে দেশের প্রায় সব মানুষই শান্তিপ্রিয় এবং প্রগতিশীল বলেই বাংলাদেশ টিকে আছে এবং এগিয়ে যাচ্ছে। যাই হোক স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের কথায় ফিরে আসি।

বাঁশ বাগান, পাড়ভাঙ্গা পুকুর; আধা নেংটা, ময়লা কাপড় আর অপুষ্টির শিকার ময়লা-নাকের একদল ছেলে-মেয়ে আর তাঁদের জীর্ণদশার মা-বাবা নিয়ে অফিস কাটে কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন সাব-সেন্টার কিংবা উপজেলা সদরে কাজ করা স্বাস্থ্য ক্যাডারের বিসিএস কর্মকর্তাদের।

ইউনিয়ন সাব-সেন্টার, কমিউনিটি ক্লিনিকে কাজ করতে গিয়ে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন পেরিফিরিতে কাজ করা এসব ডাক্তার। ক্লিনিকে আসতে দেরী হলে বা ওষুধ না থাকলে গ্রামের মেম্বার পর্যন্ত ঝাড়ি মারে, বাজারের একমাত্র ফার্মেসির মালিক ডাক্তার দেখলে নিজের ভবিষ্যৎ সঙ্কটাপন্ন ভেবে প্রমাদ গুনে পায়ে হেঁটে আসা-যাওয়া করা সরকারি ডাক্তারদের দিকে দু/একটা তির্যক মন্তব্যও ছুঁড়ে দিতে কার্পণ্য করেন না । গ্রামের রাস্তায় পায়ে হেঁটে একজন ম্যাজিস্ট্রেট বা এএসপি অফিস করতে যাচ্ছেন, এ কথা কেউ ভাবতে পারবেন?

উপজিলা বা জেলা লেভেলের হাসপাতালে সকাল ৮ টা থেকে দুপুর ২ টা পর্যন্ত আউটডোরে প্রতিদিন কী বিশালসংখ্যক গরীব মানুষের সমাগম ঘটে তা কি আমাদের জনপ্রশাসনের বড় কর্মকর্তা বা এমপি, মন্ত্রীরা ভাবতে পারেন? আর যেসব রোগী আসেন তারা প্রায় সবাই একেবারে দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর। কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে শুরু করে জেলা হাসপাতাল সবখানে একই চিত্র। যাদের পকেটে বৈধ/অবৈধভাবে উপার্জিত টাকার অভাব নেই তারাতো পারতপক্ষে সরকারি হাসপাতালের দিকে খুব একটা যান না। সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডাক্তাররা সীমিত সুযোগ-সুবিধার মধ্যে যাদেরকে সেবা দেন তাদের মধ্যে ভিক্ষুক থেকে শুরু করে রিকশাওয়ালা, সুইপার, সরকারি-বেসরকারী অফিসের নিম্নপদস্থ কর্মচারী, গ্রামের গরীব কৃষক ও তাদের ছেলে-মেয়েরা, ফুটপাতের ফলের দোকানী, পান-সিগারেট বিক্রেতা, কাজের বুয়া, আহত গরীব মুক্তিযোদ্ধা ইত্যাদি অভাবগ্রস্থ মানুষজনই বেশী আসে।

ডাক্তারের কাজটাই এমন যে ‘ব্যক্তিগত সহকারীর কাছে কাগজ রেখে যান’ টাইপের কথা বলে সেবা প্রত্যাশী মানুষকে এড়িয়ে চলার সুযোগ নেই। একজন ডাক্তার নিজ হাতে সরাসরি এসব গরীব মানুষকে সেবা দিয়ে যান। বিশেষ করে কমিউনিটি ক্লিনিকে এমন সব মানুষ আসেন যাদের সেবা করা অবস্থায় কোন ডাক্তারকে দেখলে মনে হয় মাদার তেরেসা আবার পৃথিবীতে কাজ করতে এসেছেন। হয়ত পাশের ক্ষেতে কাজ করছিলেন কোন কৃষক ভাই, ডাক্তার দেখে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। গ্রামের মধ্যেও যারা সবচেয়ে গরীব তারা আসেন কমিউনিটি ক্লিনিকে। এরা এমন সব মানুষ যারা নিজে থেকে কোনদিনও হাসপাতালে যাবেন না। এরা খুবই গরীব। এদের পকেটে নগদ অর্থ খুবই কম থাকে।

জেলা/উপজেলা পর্যায়ে যাওয়া-আসার মত, দরকারি- অদরকারি নানা টেস্ট করানোর জন্য অনেক টাকা-পয়সা এদের কাছে থাকেনা। চিকিৎসা না পেতে পেতে অনেক ক্ষেত্রে এরা বিনা চিকিৎসায় জীবন কাটিয়ে দিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। গ্রামীণ নারীদের অধিকাংশই স্বামীর ভয়ে কিংবা সংসারের খরচ বেড়ে যাবে ভয়ে শহরে ডাক্তারের কাছে যেতে চান না। ঘরের পাশে বড় ডাক্তার এবং ফ্রি ওষুধ পেয়ে গ্রামীণ দরিদ্র নারীদের সিংহভাগ এই কমিউনিটি ক্লিনিক বা সাব-সেন্টারে আসেন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশে অবকাঠামোগত এবং অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের কাজে হাত দেয়ার পাশাপাশি দেশজুড়ে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের কাজ শুরু করেছিলেন। জাতির পিতা হিসেবে তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে জাতির অর্থনৈতিক এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন টেকসই হবেনা। ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট দেশীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক অশুভ শক্তির ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধু শাহাদাত বরণ করলে অন্যান্য প্রতিটি উন্নয়ন পরিকল্পনার মত কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পও বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ অচলাবস্থার পর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ আবার ক্ষমতায় এসে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো আবার চালু করার কাজ হাতে নেয়া হয়। বিএনপি-জামাত জোট ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে এই কমিউনিটি ক্লিনিকসমূহ আবার বন্ধ করে দেয়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে জিতে আওয়ামীলীগ আবার ক্ষমতায় এসে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো চালু করে। বর্তমানে এগারো হাজারেরও বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করা হয়েছে। গরীব মানুষের দোরগোড়ায় মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে এসবের বিকল্প নেই।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমনও পরিকল্পনা করেছিলেন যে, ঢাকার বড় বড় ডাক্তাররা ছুটির দিনে বাধ্যতামূলক ভাবে গ্রামে যাবেন এবং গরীব মানুষকে ফ্রি চিকিৎসা দিয়ে আসেবেন। ১৯৭২ সালের ৯ অক্টোবর তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) এ এক অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “যখন ছুটি দেওয়া হবে, যে বড় ডাক্তাররা আছেন, যারা স্পেশালিষ্ট, তারা গ্রামের দিকে কেন যাবেন না। গ্রামে তো শতকরা ৯৫ জন লোক বাস করে। তারাই তো সম্পদ দিয়ে আপনাদের সবকিছু দেখেছে।...তাদের দিকে কেন নজর দেবেন না?”
ডাক্তারদের কাজই হল মানুষের সেবা দেয়া। তবে আজ এত বছর পরেও কেন এত অসংগতি? সরকারী ডাক্তারদেরকে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান না করলে তাঁরাও যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হবেন না। সরকারের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হয়েও যারা প্রায় ঘরে ঢুকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বিশেষজ্ঞ সেবা দেন তাদের প্রতি রাষ্ট্র বাড়তি যত্ন নিবেন এটাই কাম্য। কিন্তু বাস্তবে রাষ্ট্রের কাছ থেকে মাস শেষে বেতন ছাড়া আর কিছু এই প্রান্তিক সরকারী ডাক্তাররা যথাযথভাবে পান না। বসবাস, নিরাপত্তা এবং যাতায়াতের সুবিধা বাদ দিলাম, চাকুরী জীবনে প্রোমোশনটা পর্যন্ত পান না ঠিকমত। শুধু কি সার্ভিস দেন তাঁরা? ভালো চিকিৎসক হওয়ার পথে এমবিবিএস তো এদের কাছে প্রাথমিক কোন ডিগ্রী। আসল পড়ালেখা শুরু হয় তো পরে। কী অমানবিক প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে এফসিপিএস, এমএস/এমডি’র মত ডিগ্রী অর্জনের জন্য সংশ্লিষ্ট কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হয় তা শুধু ডাক্তাররাই জানেন।  আর কিছুটা টের পান তাদের পরিবার পরিজনরা।

সোনার বাংলা গড়তে হলে সরকারী ডাক্তারদেরকে যথাযথ সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। রাষ্ট্র এবং সমাজ পরিচালিত হতে হবে মেধা এবং সেবার হিসেবে। সমাজকে যে যত সেবা দিবেন, যে ধরণের সেবা দিবেন, তার উপর ভিত্তি করে সেবা প্রদানকারী রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন- এটাই হবে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলমন্ত্র। একদল আমলা সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করবেন, আর বাকি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সাধারণ মানুষ যথাযথ সুযোগ সুবিধা পাবেন না, সন্মান পাবেন না- এটা হতে পারেনা। বঙ্গবন্ধু  এ জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন করেননি। তিনি সিস্টেম বদলাতে চেয়েছিলেন।

১৯৭৫ সালের ১৯ জুন তারিখে বঙ্গভবনে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) এর কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে দলীয় চেয়ারম্যান রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ প্রদান করেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, “যে সিস্টেম আজকে আমরা দেখি, সেই সিস্টেম ব্রিটিশ কলোনিয়াল সিস্টেম, এতে দেশের মঙ্গল হতে পারেনা।...সেই এডমিনিস্ট্রেশন, সেই সিস্টেম, সেই আইন, সেই সব কিছু পরিবর্তন করার নামই বিপ্লব”।  চলুন সবাই একটু চিন্তা করি, বঙ্গবন্ধু যে সিস্টেমের সমালোচনা করে তাকে বদলাতে চেয়েছিলেন, সেই সিস্টেম কতখানি বদলেছে? আরাম আয়েশ আর দাফতরিক আনুগত্যের সিস্টেম বদলেছে নাকি দিন দিন আরও শক্তিশালী হচ্ছে?

>> কালেক্টেড পোস্ট <<

Saturday, September 17, 2016

ঢাল নেই, তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার--- ডাক্তার


সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজার সাম্প্রতিক একটি ফিচারে উনি বলেছেন সরকারী হাসপাতালের ঢাল তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সর্দার হোল ডাক্তার। জীবনে এই প্রথম বোধ হয় একজন ননমেডিকেল ব্যক্তির মুখে এ চরম সত্যি কথাটা শুনলাম। 

মনে পড়ে তখনকার কথা। যখন সরকারী হাসপাতালের সি এ ছিলাম। এপ্রোনের বাইরে, উপর নীচে চারটা এবং ভিতরে দু' টো, মোট ছয়টা পকেটে ইমারজেন্সী ঔষধ নিয়ে ঘুরতাম। কারন হাসপাতাল ঔষধ দিতে অপারগ ছিল। তাই ব্যক্তিগত ফান্ড কালেকশন থেকে নিজ সংগ্রহে রাখতাম। সবার যাকাতের টাকা সংগ্রহ ছিল একটি বিশেষ যোগ্যতা।

১। একরাতে তিনটি প্লাসেন্টা প্রেভিয়া একই সাথে এল প্রচুর রক্তক্ষরন নিয়ে। তিনজনাই ছিল অসহায়। কান্না পেয়ে গেল। রোগীর জন্য নয়। নিজের জন্য। নিজের অসহায়ত্ত্বের জন্য। ক্যামনে কি করব তাই ভেবে। রক্তের ব্যাগ ছিল তখন তিনশত টাকা। একজনার স্বামী মুখের উপর বলে গেল " তিনশত টাকা দিয়েতো আর একটা বিয়েই করতে পারব। সরকারী হাসপাতালে আসছি যেমনে পারেন আপনারা কাজ করবেন।" ডাক্তার থাকে তোপের মুখে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যখন নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়।
সংগৃহীত যাকাতের টাকাই ছিল অবলম্বন। তিনজনকেই রক্ষা করা গেল। কোথায় ছিল সরকার আর তার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আজও সেকথা মনে রেখে ঢাকা মেডিকেল ও মিটফোর্ড মেডিকেলে রক্ত কেনার জন্য যাকাতের অংশ দিয়ে থাকি।

২। ইমারজেন্সি গেটের বাইরে ফেলে যাওয়া বেওয়ারিশ সেপটিক এবরশনের মুমূর্ষু মহিলাকে ভর্তি করল আমাদের ইউনিটে। ইনজেকশন রসিফিন দরকার। হাসপাতাল অপারগ। আবারও ব্যক্তিগত ফান্ড।

৩। বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। পোস্টঅপারেটিভ খারাপ প্রফাইলের পেসেন্ট, হঠাৎ রেসপিরেটরী ডিস্ট্রেস। সরকারী মেডিকেলে ট্রান্সফার করা আবশ্যক। কিন্তু পথে মারা যাবার সম্ভাবনা অথবা হাসপাতালে আই সি ইউ পাওয়া না গেলে শতভাগ মৃত্যুর সম্ভাবনা এড়াতে প্রাইভেটের আই সি ইউ তে ট্রান্সফার। বিনে খরচে পেসেন্টের ভাল হয়ে বাড়ী যাওয়া। আবারও নিজস্ব ফান্ড।

গল্পগুলো বলার উদ্দেশ্য কি? উদ্দেশ্য হোল এইসব গরীব পেসেন্টের চিকিৎসা সামগ্রী যোগাড় করার দায়িত্ত্ব কার?
 নিশ্চয়ই চিকিৎসকের নয়। এ দায়িত্ত্ব সরকারের।
 কিন্তু এই জোড়া তালির অভিজ্ঞতা নেই এমন কোন সি এ রেজিস্ট্রার পাওয়া যাবেনা। এই ঢাল তলোয়ারবিহীন ডাক্তাররা কিভাবে হাসপাতাল চালায় তা বোঝার জন্য মোর্তোজার মত বিচক্ষন ও নিরপেক্ষ হতে হবে।

পক্ষান্তরে বিদেশী চিকিৎসা।সব খরচ সরকার বহন করে। চিকিৎসক শুধু মগজ খাটায় আর হুকুম করে। মগজ খাটিয়ে এই হুকুমটি দেবার জন্য জীবনে যত কাঠ খড় তাকে পোড়াতে হয়েছে তা অন্য কোন প্রফেশনে হয়নি। তাই এই হুকুমটিই মহামূল্যবান। নার্সরা সব পুং্খানু পুং্খভাবে তা পালন করে। নার্স হাত বাড়ায় আর সব জিনিস চলে আসে। এবং তাদের ম্যানেজমেন্ট নিম্নরূপ।

অস্ট্রেলিয়ান ইমারজেন্সি : খুব কাছের লোক। একসিডেন্টে মাথা ফেটে গেছে। কিছু রক্তক্ষরনও হচ্ছে। ঘন্টার পর ঘন্টা বসিয়ে রেখেছে এই বলে " তুমিতো মারা যাচ্ছ না। তোমার চেয়ে খারাপ পেসেন্ট আছে। ওকে আগে ম্যানেজ করে নেই"।

কানাডার ইমারজেন্সি : খুবই কাছের লোক।পি পি এইচ এর পেসেন্ট। হাসপাতালে ব্লাড দিতে হয়েছে। বাড়ী আসার পরে আবার ব্লিডিং হওয়াতে ইমারজেন্সি এপয়ন্টমেন্ট নিল সন্ধ্যে সাতটায়। নিউবর্ন বেবীসহ সেই পেসেন্টকে দেখল ভোর চারটায়।

এমন প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশে ভাংচুর এবং চিকিৎসক পিটানো অনিবার্য।

যদিও এই সস্তা এবং সহজলভ্য ডাক্তারদের দেশে এভাবে ইমারজেন্সি পেসেন্ট বসিয়ে রাখা হয় বলে আমার জানা নেই।
এই চিকিৎসক পিটানো এবং অকারনে চিকিৎসকদের হাজতে ঢুকানোর যে ট্রেন্ড চলছে এর পরিসমাপ্তি কোথায়? যে ছেলে মেয়ের গায়ে জীবনে কোন শিক্ষকও হাত তুলতে পারেনি ভাল ছাত্র, ছাত্রী বলে তাদের আজ মাস্তানের মার খেতে হচ্ছে পেশাগত কাজ করার সময়ে-- এ লজ্জা অপমান কি করে সহ্য করছে চিকিৎসক সমাজ? চিকিৎসকদের একতাব্দ্ব হয়ে কিছু করার সময় এসে গেছে। ডাক্তারদের অন্যায় ভুল ত্রুটির বিচার ডাক্তাররাই করবে। তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব ও নিজেদেরই নিতে হবে।

কিন্তু গলদটা কোথায়?

>>কালেক্টেড পোস্ট<<

Wednesday, September 14, 2016

আপনার স্বপ্ন কি?

নেপথ্য

পর্ব-১
জনৈক রুগী চেম্বারে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখানোর পর ভিজিট কত জিজ্ঞেস করলে ডাক্তার বললেন ৬০০ টাকা। রুগী ডাক্তারকে ভিজিটের টাকা পকেট থেকে বের করে দিতে দিতে বললেন, "আপনাদের ডাক্তারদের ভিজিট অনেক বেশি কেন?"

ডাক্তার সাহেব রুগীকে বললেন, "আপনার এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেয়া সম্ভব নয়। আর আপনাকে ব্যখ্যা দিয়ে বুঝিয়ে বললেও আপনি হয়তো শুনবেন, কিন্তু উপলব্দি করতে পারবেন না। আচ্ছা, আপনার বয়স কত?"
-৩৫ বছর।

কি করেন?
-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি।

আপনার ছেলেমেয়ে কয়জন?
-এক ছেলে নির্ঝর আর এক মেয়ে নাঈমা।

তাদের বয়স?
-মেয়েটার পাচ বছর আর ছেলেটা তিন।

তাদের নিয়ে আপনার স্বপ্ন কি?
-মেয়েটাকে ডাক্তার বানানোর ইচ্ছা আর ছেলেটাকে ইঞ্জিনিয়ার।

তাহলেতো হয়েই গেল। দোয়া করি আপনার মেয়ে যেন অনেক বড় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হয়। যেহেতু আপনি আপনার মেয়েকে ডাক্তার বানাতে চাচ্ছেন আর তার বয়স এখন পাচ বছর, ভিজিট সংক্রান্ত এই প্রশ্নের উত্তর আপনি ৩৫/৪০ বছর পরে বেচে থাকলে পেয়ে যাবেন। এই নিন আমার ব্যক্তিগত সেলফোন নাম্বার। ততদিন যদি আমি বেচে থাকি, আর আপনি যদি আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যান তাহলে দয়া করে আমার সাথে দেখা করে জানিয়ে যাবেন।
জ্বী আচ্ছা বলে রুগী ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এল।

পর্ব ২

পাচ বছরের সেই ছোট্ট নাঈমা এখন বেশ বড় হয়েছে। এইতো কিছুদিন আগে তার এইসএসসি রিটেন এক্সাম শেষ হলো। প্রাকটিক্যাল এখনও শুরুই হয়নি। এরই মধ্যে মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য কোন কোচিং এ ভর্তি হবে তার তোরজোর শুরু হয়ে গেছে। পরীক্ষার পরে কোথায় বিশ্রাম নিবে কিংবা বেড়াতে যাবে সেসব চিন্তা বাদ। বাবা মা আত্নীয়স্বজন সকলের স্বপ্ন তাকে ডাক্তার হতে হবে। আর এই স্বপ্ন পূরনের ধারাবাহিকতায় তাকে এক এক করে অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে আসতে হয়েছে। প্রাইমারী স্কুল পরীক্ষায় সে বৃত্তিও পেয়েছে। জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষাও বৃত্তিসহ উত্তীর্ণ হয়েছে। ভালো রেজাল্ট করেছে এসএসসিতেও। আশা করছে এবারও রেজাল্ট ভালো হবে। বাবা মা বলেছে এইবারই শেষ কষ্ট। মেডিকেলে চান্স পেলে আর কষ্ট করতে হবে না। আর পিছন ফিরে তাকাতে হবে না। বাবা মা আর নিজের স্বপ্ন পূরনের লক্ষ্যে দৃঢ় থাকে নাঈমা।

এরপর প্রাকটিক্যাল এক্সাম শেষ করে, একটি কোচিং সেণ্টারে ভর্তি হয়ে দিন রাত আগের থেকেও বেশি পরিশ্রম করে অবশেষে পেয়ে যায় সেই কাংখিত সাফল্য। একটি সরকারী মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়ে যায় সে। নাঈমার পুরো পরিবারে আনন্দের বন্যা। প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সের নাঈমার বাবার চোখে তখন স্বস্তির আশ্বাস। মেয়ে তার ডাক্তার হবে। এইতো দেখতে দেখতেই পাচটি বছর কেটে যাবে।

মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে কিছুদিন নাঈমার ভালোই কাটলো। এপ্রোন পড়ার আনন্দ, নতুন নতুন বন্ধু, নতুন পরিবেশ, নতুন নতুন রঙ্গীন বই। জীবনটাকেই তার রঙ্গীন লাগছে। আরও বেশ কয়েকমাস যেতেই নাঈমা আবিষ্কার করলো তার রঙ্গীন জীবনের রংয়ে সাদাকালোর প্রোলেপ পরতে শুরু করেছে! নিয়মিত ক্লাশ, একের পর এক আইটেম, কার্ড ফাইনাল, প্রফের ধাক্কা সামলাতেই তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সে খোজ নিয়ে দেখলো তার ননমেডিকেল বন্ধুরা যখন বিকেলের সোনালী রোদে আড্ডা দিয়ে কিংবা ঘুরাঘুরি করে বেড়াচ্ছে তখন সে কিংবা তার মেডিকেলের বেশিরভাগ বন্ধুরাই লাইব্রেরীর চারদেয়ালে টিউব লাইটের আলোয় বইয়ের পাতায় ডুবে আছে। সেখানে বিকেলের সোনালী রোদ স্পর্শ করে না! নাঈমার বাবা নাঈমার এই অবস্থা কিন্তু ঠিকই দেখছিল। আর তার কাছে পাচ বছরটাকে শুধু দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতরই মনে হচ্ছিল।

কিন্তু অন্ধকারের পরতো আলোর দেখা মিলবেই। ঠিক তেমনিই অনেক অনেক কষ্টের পর নাঈমাও পেয়ে গেল মেডিকেল সাইন্সে গ্রাজুয়েট ডিগ্রী। আরেকবার হাসলো তার পঞ্চাশোর্ধ বাবা। এইবার বুঝি তার কষ্টের দিন শেষ হতে চলল। ইণ্টার্নশীপ শেষ করতে করতে মেয়ের বিয়েও দিলেন। ছেলেরও ততদিনে ইঞ্জিনীয়ারিং শেষের পথে। যদিও ছেলে মেয়েকে এই পর্যায়ে নিয়ে আসতে তাকে কি কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তা একমাত্র তিনিই জানেন।
একদিন নাইমাকে ডেকে তিনি বললেন, "মারে, ইণ্টার্নীতো শেষ করলে। এখন কি ভাবছো?

-বাবা, সামনে বিসিএস প্রীলিমিনারী পরীক্ষা। আর জানুয়ারীতে এফসিপিএস পার্ট-১ পরীক্ষা। এইসব পরীক্ষার প্রস্তুতি নিব।
আচ্ছা মা। ঠিক আছে। পড়াশুনাটা চালিয়ে যাও।

এভাবেই একটি ক্লিনিকে পার্ট টাইম চাকরী করে বিসিএস আর এফসিপিএস এর প্রস্তুতি নিতে নিতেই দিন পার করছিল নাঈমা। কিন্তু দুটোর প্রস্তুতি নিতে গিয়ে কেমন যেন গোলমেলে মনে হচ্ছিল তার কাছে। দুটো পরীক্ষার প্রস্তুতি যে দুই রকম। নাহ! এভাবে হবে না। দুটো একসাথে চালানো যাবে না। অতঃপর একটার মায়া তাকে ছাড়তে হয়। এরই মাঝে সে দেখছে তার কোন কোন বন্ধু অনারারী (বিনা বেতনে) ট্রেনিংএ ঢুকেছে কোনও কোনও হাসপাতালে। তা যেন আরেক দূরহ জীবনের অধ্যায়। বিএসএমএমইউ এর লাইব্রেরীর এক একটা দিন যেন এক একটা পূর্ণদীর্ঘ চলচিত্রের কাহিনী। যা সকাল আটটায় শুরু হয়ে ৩৫ টাকার দুপুরের খাবারের মধ্য দিয়ে রাত দশটায় শেষ হয়। নাঈমা নিশ্চিত তার অনেক আত্নীয়স্বজনও এই খাবার এক বারের বেশি দুইবার মুখে দিতে পারবে না। পরীক্ষা পড়াশুনার চাপে সামাজিক অনেক অনুষ্ঠানেও আজকাল নাঈমার যাওয়া হয়ে ওঠেনা। আত্নীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কেউ কেউ বলছে, ডাক্তার হয়ে নাঈমার ভাব বেড়ে গেছে। কেউ কেউ আবার তাকে অসামাজিকও ভাবতে শুরু করছে। গ্রাম থেকে অনেকে আসেন বেশ আশা করে। ডাক্তার দেখানোর ব্যপারে নাঈমা সাহায্য করবে বলে। ডাক্তারের সিরিয়াল দিয়ে দেয়া, ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যাওয়া, হাসপাতালে ভর্তি করানো। আরও কত কি। মাঝে মাঝে নাঈমা করে ঠিকই কিন্তু সব সময় একইভাবে করা সম্ভব হয় না। তার পড়াশুনা কিংবা পরীক্ষার চাপ অন্যরা কিভাবে বুঝবে? তারা শুধু ভুলই বুঝতে পারে।

দেখতে দেখতে নাঈমা সন্তানের মা হয়ে যায়। জীবনে আনন্দের ধারা নেমে আসে। কিন্তু সমান তাল বেড়ে চলে কষ্টের ধারাও। ধীরে ধীরে সময় বেড়ে চলে। বয়স বাড়ে নাঈমার। তবুও থেমে থাকে না জীবনে বড় ডাক্তার হবার স্বপ্ন। সদ্য অবসরে যাওয়া নাঈমার বাবাও চোখের সামনে দেখতে থাকে মেয়ের জীবনযুদ্ধ। তার আশার মাঝেও যেন মেঘ জমতে শুরু করেছে ততদিনে। সবাই যেন অধৈর্য্য হয়ে পড়ছে। নাঈমার ডাক্তারী পড়া কেন শেষ হয় না! নাঈমার ভাইও যে ততদিনে ইঞ্জিনীয়ার হয়ে চাকরী শুরু করে দিয়েছে। সবার ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটলেও শুধু নাঈমারই ধৈর্য্যের বাধে ফাটল ধরে না। সংসার, সন্তান লালন-পালন, চাকরী, পড়াশুনা সমান তালে এগিয়ে নিয়ে যায় সে। শুধু হারিয়ে যায় বিকেলের সোনালী রোদ, জীবনের ছন্দ, গান, কবিতা, একটুখানি অবসর। নিজেকে নিয়ে কিংবা নিজের জন্য একটুখানি সময় হয়ে ওঠে না আর নাঈমার। এক রোবটিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যায় সে।

এভাবেই বছরের পর বছর কেটে যায়। ভারী ভারী বইয়ের ব্যাগ বইতে যেয়ে পিঠের মাংশপেশীর ব্যথাটাও জানান দেয় মাঝে মাঝে। পয়ত্রিশোর্ধ নাঈমা একদিন নিজেকে আবিষ্কার করে একজন পোস্ট গ্রাজুয়েট ডাক্তার হিসেবে। অতঃপর চেম্বার প্রাকটিস শুরু করে নাঈমা। তার ভিজিট ১০০০ টাকা। সেই পাচ বছর থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত উঠে আসা নাঈমার প্রতিটা দিনের কালের স্বাক্ষী হয়ে থাকল পয়ষট্টিরও বেশি বয়সী তার বাবা।

পর্ব ৩ (শেষ পর্ব)

সকাল আটটা বেজে দশ। বাইরে বেশ রোদ উঠেছে। সাথে ঝিরঝিরে বাতাসও বইছে হালকা আমেজে। একটু দূরে নিম গাছে একটা কাক ডাকছে সমানে। মিরপুরের বর্ধিত পল্লবীর ২ নং রোডে খন্দকার ভিলার দোতালার বারান্দায় বসে দিনের পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছেন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডাঃ খন্দকার মোস্তফা খালেদ। দেশের নাম করা বিশিষ্ট কিডনী রোগ বিশেষজ্ঞ। বয়স আশির কাছাকাছি। এখন আর রোগী দেখেন না। ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, প্রোস্টেট গ্লান্ড বড় হওয়া ইত্যাদি রোগে ভুগছেন তিনি। তবে মাঝে মাঝে এই বয়সেও দেশ বিদেশের বিভিন্ন সেমিনারে বক্তৃতা দিয়ে থাকেন। চায়ের কাপে চুমুক দিবেন এমন সময় সেলফোনে রিং বেজে উঠলো। তিনি রিসিভ করে বললেন, হ্যালো, কে বলছেন?

-স্যার আমি সাজ্জাদুর রহমান। আপনি হয়তো আমাকে নাও চিনতে পারেন। আবার চিনতেও পারেন। স্যার, আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই। আপনি কি আমাকে একটু সময় দিবেন?

"হা হা হা। আমার সময়ের কোন অভাব নাই।" এই বলে বাসার ঠিকানা দিয়ে খন্দকার সাহেব ফোন রেখে দিলেন।
বিকেল বেলা খন্দকার সাহেবের ড্রয়িং রুমে দুই জন বৃদ্ধ মুখোমুখি বসে আছেন। বয়সের ব্যবধান পনের বছর। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছেন। কারও মুখে কোন কথা নাই অনেক সময় ধরে। অবশেষে সাজ্জাদুর রহমান নিরবতা ভাংগলেন।

স্যার, আজ থেকে অনেক বছর আগে আমি আপনার চেম্বারে গিয়েছিলাম। তখন আমার মেয়ের বয়স ছিল পাচ বছর। আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে আপনাদের ডাক্তারদের ভিজিট এত বেশি কেন? আজ আমার মেয়ে একজন প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার। কিন্তু তার এই প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠার পিছনে যে গল্প তার প্রতিটা লাইনে আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে আপনারা যা ভিজিট নেন তা হয়তো ঠিকই আছে। আমরা দূর থেকে আপনাদের শুধু ভুলই বুঝি। কিন্তু আপনাদের একজন ডাক্তার হবার পিছনে যে শ্রম, মেধা, সময় ব্যয় করেন সেই তুলনায় আপনাদের ভিজিট সত্যিই কম স্যার। এরপর সাজ্জাদুর রহমান ডাক্তার সাহেবকে সালাম দিয়ে বললেন,
স্যার আসি।

বলেই দেরী না করে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ডাঃ খন্দকার মোস্তফা খালেদ চুপচাপ খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

©Rasel sheikh.

Wednesday, September 7, 2016

জয় কেরানিতন্ত্র

বুয়েট থেকে পাস করা ইঞ্জিনিয়ার কিংবা মেডিকেল থেকে পাস করা ডাক্তারের চেয়েও আরবি কিংবা উর্দু বিষয়ে পড়ে মুখস্থ করে বিসিএস ক্যাডার হওয়া আমলার দাম যে রাষ্ট্রে বেশি সেখানে মেধাবীরা থাকবে কেন? 
একই কথা বলা যায় যে কোন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা প্রকৌশলী কিংবা কৃষি বিষয়ক লেখাপড়া করা ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে। কারিগরী পেশার এইসব ছেলেমেয়ে কেন দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে সেটা কী আমরা কখনো ভেবেছি।

তার আগে বলে নেই কোন বিশেষ বিষয়ের প্রতি আমার বিদ্বেষ বা প্রীতি নেই। আমি বলছি না উর্দু বা আরবি বাদে অর্থনীতি, ইংরেজি কিংবা অন্য কোন ভালো বিষয় থেকে পাস করা অ্যাডমিন ক্যাডার নেই। অবশ্যই আছে। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তারের চেয়ে এই দেশে তাদের মেধা কখনোই বেশি নয়। কেউ স্বীকার করুন বা নাই করুক এই দেশে এখনো স্কুলের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেমেয়েরাই বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে। এরপর বুয়েট মেডিকেলে যায়। সেই তুলনায় একটু পেছনের সারির ছেলেটা মানবিকে বা কমার্সে পড়ে। অথচ লেখাপড়ার পর দেখা যাচ্ছে এই রাষ্ট্রের প্রশাসনে ডাক্তার–ইঞ্জিনিয়ারদের চেয়ে সেই ছেলেটিরই কদর বেশি যে কী না ক্লাসের পেছনের সারিতে ছিল।

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি কলা বা সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের যে ছেলেমেয়েগুলো কাঙ্খিত বিষয়ে ভর্তি হতে পারতো না তারা প্রথম বর্ষ থেকেই বিসিএসের গাইড মুখস্থ করতে শুরু করেছে। বিশ্ববদ্যিালয়ের লেখাপড়ার প্রতি তাদের কোন মনোযোগ নেই বরং তাদের সব আগ্রহ ওই চাকুরির লেখাপড়াকে ঘিরে।

একেবারেই উল্টোচিত্র ডাক্তার, ইঞ্জনিয়ার কিংবা কৃষি বা বিজ্ঞানে পড়া ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে। হঠাৎ করে চাকুরির পরীক্ষা দিতে এসে তারা সাধারণ জ্ঞান নিয়ে হাবুডুব খেতে শুরু করে। অনেক কষ্ট করে যেই ছেলেটি বিসিএসে স্বাস্থ্য, কৃষি কিংবা প্রকৌশলী ক্যাডারে নিয়োগ পেলো কিংবা কলেজের শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিলো চাকুরি শুরুর কিছুদিন পরেই তিনি বুঝতে পারেন ক্লাসের পেছনের সারির সেই ছেলেটি আজ তার বস হয়ে গেছে। কারণ তিনি প্রশাসনের কর্মকর্তা।

সিরাজগঞ্জের একজন কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল একবার। তিনি একযুগেরও বেশি সময় ধরে কৃষি কর্মকর্তা। বহুকষ্টে মোটরসাইকেলে চড়ে আমার সঙ্গে একটা নিউজের বিষয়ে কথা বলতে স্পটে এসেছিলেন। নানা বিষয়ে তাঁর গবেষণা।ফসলের কীটপতঙ্গ নিয়ে তিনি কাজ করছেন। তার সেই কাজ দেখতে জাপান থেকে লোকজন এসেছে। তারা তাকে জাপানেও নিয়ে যেতে চায়। সেই কর্মকর্তা আফসোস করে জানালেন, চোখের সামনে কতো জুনিয়র এসে ইউএনও হয়ে ডিসি হয়ে চলে গেছে। আফসোস করে বললেন, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর দ্বিতীয়বার গিয়েছিলেন প্রশাসন ক্যাডারের চাকুরির জন্য। ভাইভা বোর্ডে ইয়াজউদ্দিন স্যার তাকে বলে, বাবা তুমি কৃষিতে পড়েছো। কৃষি ক্যাডারেই থাকো। কৃষকের জন্য কিছু করো। এরপর ভাইভা না নিয়েই তাকে পাঠিয়ে দেন। এখন তাঁর মাঝে মাঝেই সরকারি চাকুরি নিয়ে আফসোস লাগে।

অনেক ডাক্তারকে বলতে শুনেছি, আমাদের আমলাতন্ত্রে ৭ম বিসিএসের একজন সিভিলসার্জনকে তার সন্তানের বয়সী সাধারন বিষয়ে পাস করে আসা ৩৩ বিসিএসের একজন ম্যাজিস্ট্রেট যখন 'সিএস সাহেব' বলে সম্মোধন করেন তখন তার প্রচণ্ড মন খারাপ হয়। আবার পরীক্ষার হলে সরকারী কলেজের সিনিয়র এসিস্ট্যান্ট প্রফেসরকেও প্রশাসন ক্যাডারে সদ্য নাম লেখানো ম্যাজিস্ট্রেট 'অমুক সাহেব' বলে সম্মোধন' করবেন এটাই যেন খুব স্বাভাবিক।

আমার কথায় আমলাতন্ত্রের শীর্ষ পদের অনেকেই মন খারাপ করতে পারেন তবুও বলছি আমাদের দেশের রাজনীতি তো নষ্ট। আমরা অনেক কিছুর জন্যই তাই রাজনীতিবিদদের দায়ী করি। কিন্তু নোংরা রাজনীতির পাশাপাশি বাংলাদেশের অনিয়ম দুর্নীতি আর পিছিয়ে থাকার একটা বড় কারন এই কেরানিতন্ত্র যাকে আপনারা বলেন আমলাতন্ত্র। জঘন্য মুখস্থ বিদ্যার বিসিএস আর কোটাতন্ত্র এই আমলাতন্ত্রের আরো ১২ টা বাজিয়েছে। বিসিএস দিয়ে মেধা তালিকার ৫০০ এর মধ্যে থেকেও চাকুরি পাবে না আবার কোটার কারণে দুই হাজারতম হয়েও চাকুরির ব্যাবস্থা আমাদের পুরো আমলাতন্ত্রের মান নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। অন্তত আমার কাছে।

আমি বলছি না প্রশাসনে সৎ লোক নেই, অবশ্যই আছে, কিন্ত আমার কাছে মনে হয় আমাদের টোটাল আমলাতন্ত্রটাই মানুষকে কষ্ট দেয়ার তন্ত্র। ব্রিটিশরা কেরানি বানানোর জন্য যে সিস্টেম এখানে চালু করেছিল আজো সেটি বহাল তবিয়তে টিকে আছে। সচিবদের কথা বাদ দিলাম এই দেশে অনেক সরকারি অফিসের নিম্নপদের কেরানিরও তাই লাখ–কোটি টাকা আছে। কারণ ওই কেরানিতন্ত্র।

উল্টোদিকে অনেক প্রকোশলী বা ডাক্তার একটু ভালো থাকতে দেশ ছেড়ে চলে যায় বিদেশে। আমি বলছি না অসৎ ডাক্তার বা প্রকৌশলী নেই। কিন্তু তাদের একটা বড় অংশই লেখাপড়া শেষে বুঝতে পারে বাংলাদেশের চাকুরির বাজারটা তাদের জন্য নয়। তাই যারা পারে দেশ ছাড়ে। আর গনিত কিংবা পদার্থবিজ্ঞান পড়া ছেলেটা কিছু করতে না পেরে কেরানি কিংবা ব্যাংকের টাকা গোনার চাকুরির জন্য লড়াইয়ে নামে।

আমাদের আমলাতন্ত্রে প্রশাসন ক্যাডারের কাছে ক্ষমতাই সব। আমাদের এই আমলাতন্ত্র এতোটাই শক্তিশালী যে আরবি থেকে পাস করেও কোন কর্মকর্তা এখানে কৃষি কিংবা স্বাস্থ্য সচিব বনে যান। আমি কোনভাবেই বুঝি না কৃষি ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা কেন কৃষি সচিব হবেন না? কেন স্বাস্থ্য ক্যাডারের বদলে ইংরেজি পড়া ছেলেটিকেই স্বাস্থ্যসসচিব হতে হবে। কেন একজন শিক্ষক শিক্ষাসচিব হবেন না?

অনেকেই বলতে পারেন কোন সাবজেক্টে পড়েছে সরকারি চাকুরিতে সেটা বিষয় নয়। চাকুরি করতে করতে তিনি আসলে যোগ্য হয়ে যান। হতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এতো বিষয়ের এতো সীট না রেখে উচ্চমাধ্যমিক পাস করিয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিলেই হয়। কারণ সেই তো অনার্স–মাষ্টার্স পাস করে একটা চাকুরি পাবার জন্য আমাদের ছেলেমেয়েদের কী ভয়ঙ্কর একটা লড়াইয়ে নামতে হয়।

যারা আমাদের এই কেরানিতন্ত্রের পক্ষে যুক্তি দেবেন তারা একটু বলেন তো আমাদের সরকারি অফিসগুলোর মান কী কমছে না বাড়ছে? সাধারণ জনগন ভূমি অফিসকে কী মনে করে? আমি তো মনে করি বাংলাদেশের আজকের অগ্রগতির পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান কৃষকের, কৃষি কর্মকর্তার। এরপর ব্যাবসায়ী, গার্মেন্টস শ্রমিক, স্বল্পশিক্ষিত প্রবাসী আর বিশাল বেসরকারি খাত। আমাদের আমলাতন্ত্রের ভূমিকা সেখানে কী খুব বেশি?

খুব অবাক হই আমাদের আমলারা যখন অবসরে গিয়ে টেলিভিশন বা পত্রিকায় সংস্কারের কথা বলেন। আচ্ছা চাকুরি জীবনে কী এসব বুদ্ধি আপনাদের মাথায় আসে না? অবশ্য ৯০ এর পরে আমাদের আমলাতন্ত্র এখন এতোটাই বিভক্ত যে সিদ্ধান্ত নিতে হয় দলচিনে। এখানে কর্মকর্তাদের মানের চেয়ে দলীয় যোগ্যতাই বেশি দেখা হয়। কাজেই তারা কতোটা ভূমিকা রাখতে পারেন সেটাও প্রশ্ন।

কেউ কেউ ভাবতে পারেন হঠাৎ করে কেন এতো কথা বলছি। সরকারি চাকুরি করা এক প্রকোশলী নতুন বেতনকাঠামো নিয়ে হতাশ হয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে। সেটা দেখেই কথাগুলো মনে এলো। বেতন কাঠামো নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক খুব ভালো উদাহরণ দিয়েছেন। তার মতে মাত্রাতিরিক্ত বেতন বাড়িয়ে এতো বেশি অপমান কেউ করেনি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের কথা না হয় বাদ দিলাম তারা অনেক সুবিধা পান। কিন্তু এই দেশে যারা সত্যিকারের মানুষ গড়ার কারিগর সেই স্কুল শিক্ষকেরা কিন্তু সরকারি অফিসের অনেক পিয়নের চেয়ে কম বেতন পান। কাজেই ডাক্তার-ইঞ্জনিয়ার-শিক্ষক সব বাদ দিয়ে দেশের তরুণরা সবাই একদিন কেরানি হতে চাইবে এই দেশে সেটাই স্বাভাবিক।

অনেকে অনেক কিছু বলতে পারেন। তর্ক বিতর্ক করতে পারেন। তবে আমি কাউকে অসম্মান করছি না। কাউকে কষ্ট দিতে চাচ্ছি না। বরং বিষয়টা নিয়ে আলোচনা হোক। কারণ এই দেশের ডাক্তার–ইঞ্জিনিয়ার–আমলা সবাই আমাদেরই ভাইবোন। তবে আমি কিন্তু দেখতে পাচ্ছি এই দেশের তরুণদের একটা বড় অংশই তাদের মেধা–যোগ্যতা শেষ করে ফেলছে একটা সরকারি চাকুরির পেছনে। ডাক্তার-ইঞ্জনিয়ার-শিক্ষক সব বাদ দিয়ে দেশের তরুণরা সবাই কেরানি হওয়ার স্বপ্ন দেখবে। আর মেধাবিদের আরেকটা বড় অংশ দেশ ছেড়ে যাচ্ছে বিশেষ করে বিজ্ঞাপনে পড়া। আর যারা থাকছে তারা বিসিএস প্রকৌশলী, কৃষি বা স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা হয়ে আজীবন ছোট হয়ে থাকছে। বড়ই আজব বাংলাদেশের শিক্ষাব্যাবস্থা আর কেরানি বানানের কৌশল। এখানে সবার স্বপ্ন এখন কেরানি হওয়া। কাজেই বলতেই হয় জয় কেরানিতন্ত্র।

>>কালেক্টেড পোস্ট<<

Monday, September 5, 2016

#অনারারী_ও_রেসিডেন্সী এবং #দাসপ্রথার_সাতকাহন


 
#প্লট-১

২০১৩।আমি তখন অনারারী মেডিকেল অফিসার(HMO) হিসেবে DMCH এর মেডিসিন ডিপার্টমেন্টে।দুষ্ট লোকেরা "#অনারারী মেডিকেল অফিসার" এর স্থলে আমাদের ডাকে "#অনাহারী মেডিকেল অফিসার"। নামটা যুতসই, যে ব্যক্তির মাথায় প্রথমে অনাহারী শব্দটা এসেছিলো, তার তাচ্ছিল্য ও রসবোধের প্রশংসা করতে হয়।

কাজের কথায় আসি।কথায় বলে, "পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে"। আমার পাখা গজালো।এমনিতেই অনাহারী মেডিকেল অফিসার, তার উপর নিজের ইচ্ছায় মেডিসিনের যে ইউনিটে ঢুকেছি-সে ইউনিট থেকে অধিকাংশ ট্রেইনি ডাক্তার দূরে দূরে থাকে।"ডে- অফ" বলে কোন বিষয়ের বালাই সে ইউনিটে নেই।

যেহেতু রোস্টার ডিউটি বেশী পড়ে, একবার সব HMO মিলে চেষ্টা করলাম, কোনভাবে সপ্তাহে একটা ডে অফ ম্যানেজ করা যায় কিনা, শরীরে কুলায় না । সিএ ভাই, ইউনিট হেড- কিংবদন্তীতুল্য শ্রদ্ধেয় স্যারের সাথে দেখা করে এসে জানালেন, "স্যার বলেছেন, তোমাদের রোস্টার ডিউটি বেশী পড়লে, এখন থেকে রোস্টারে উনার নামটাও রাখতে"।

#কড়া_মেসেজ, এরপরে আর ডে অফ নিয়ে কথা বাড়ানো চলে না।আমি অবশ্য ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি ট্রেনিং এমনই হওয়া উচিত।যাই হোক, মোটামুটি অঘোষিত '#মার্শাল_ল' সিস্টেমের ভিতর দিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছি, একেবারে বিনে পয়সায়।

একদিন নাইট ডিউটি, একটু দেরী হওয়াতে দ্রুত হাতে #Stethoscope নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে রিকশা নিয়ে DMCH এর ইমার্জেন্সী গেইটে নেমে রিকশাওয়ালাকে ৬০ টাকা দিয়ে হাঁটা শুরু করা মাত্র রিকশাওয়ালা পেছন থেকে ডাক দিলোঃ
--এই যে, কত দিলেন?
--কেন, ৬০ টাকা!
--৭০ টাকা দেন দেহি...
--৭০ টাকা কেন? ডেইলি ৬০ টাকা দিয়ে আসি.....
এই কথা বলে আমি আবার হাঁটা দিলাম।পেছনে শুনলাম আমার রিকশাওয়ালা তার পাশের রিকশাওয়ালাকে বলছে, "খাডাশের দল, লাখ লাখ ট্যাহা কামায়, আর আমাগো ১০ ট্যাহা দিবার চায় না"।
থমকে দাঁড়ালাম, একবার ভাবলাম বলি, "তুমি রিকশা চালাও, পরিশ্রমের সেই টাকাটা পাও, আমি সকাল, দুপুর এমনকি রাত্রে জেগে থেকেও ডিউটি করি, একটা পয়সাও জোটে না"। কথাটা বলা হয়নি....

#প্লট_২

আবারও অনারারী ট্রেনিং পিরিয়ডের কথা। ডিউটি সেরে প্রতিদিন রিকশা করে বাসায় ফিরি।রিকশার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো-নিজেকে রাস্তার পরিবেশ থেকে আলাদা মনে হয় না, চারপাশের দৃশ্য ভালোমত দেখতে দেখতে যাওয়া যায়, গাড়ীতে সে সুযোগ নেই, গাড়ীতে অদৃশ্য পর্দা থাকে, পরিবেশের সাথে মেশা যায় না।

যে ইউনিটে ট্রেনিং করি, সেই ইউনিটের অসম্ভব Punctual একজন HMO বড় ভাইকে আমি মনে মনে যথেষ্ঠ শ্রদ্ধা করতাম, এখনোও করি।আমি পরপর কয়েকদিন বাসায় ফেরার সময় রিকশা থেকে লক্ষ্য করলাম ডিউটি শেষে ওই সিনিয়র ভাই রাস্তা দিয়ে হে্ঁটে হেঁটে বাসায় ফেরেন। প্রায় দুই কিলোমিটার রাস্তা, হসপিটাল ডিউটি কমপ্লিট করে দুপুরের রোদে দুই কিলোমিটার হেটে যাওয়াটা মুখের কথা না, মনের আনন্দে কেউ এই কাজ প্রতিদিন করবে না।
আমি একদিন ক্যান্টিনে চা খেতে খেতে ভাইকে কথায় কথায় বললাম যে উনি ইচ্ছা করলে আমার সাথে যেতে পারেন। ভাই একটু উদাস হয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন।কয়েকদিন গিয়েও ছিলেন আমার সাথে।তারপর বাদ দিলেন, বোধ হয় -লজ্জায়।

শুনেছিলাম তার কিছু করুণ কাহিনী। উনি আমার থেকে বছর পাঁচেকের বড়।নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বাবা-মা অনেক আশা করে প্রচুর ঋণ নিয়ে প্রাইভেট মেডিকেলে পড়িয়েছিলেন, ছেলে ডাক্তার হলে এসব ঋণ কোন বিষয় হবার কথা না।সেই ঋণের বোঝা টানতে গিয়ে তিনি ৪ বছর ক্লিনিকগুলোতে ডিউটি করেছেন।এক মেয়েকে পছন্দ করতেন, মেয়েও করতো, সেই সম্পর্ক নিজেই ধ্বংস করেছেন।নিজের এহেন দৈন্যহীন অবস্থায় প্রেম-ভালোবাসার মত বিলাসী জিনিস তার শোভা পায় না।
অন্যদিকে পোষ্ট গ্রাজুয়েট ট্রেনিং এর সময় তো থেমে থাকেনা।বাবা-মা যখন আশা করছেন ছেলে ডাক্তারী পাশ করে প্রাচুর্য নিয়ে আসবে, তখন তিনি ট্রেনিং এ ঢুকলেন।তার পিতা, পুত্রের ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে আবারও এখন কষ্ট করে প্রতি মাসে টাকা পাঠাতে শুরু করলেন।নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে মধ্য-মধ্যবিত্তরা তাদের ছেলেমেয়েকে ডাক্তার বানাতে চাইলে এদেশের প্রেক্ষাপটে তাদের খেসারত দিতে হবে বৈ কি!

একদিন পেশেন্ট ফলো আপ দিচ্ছি। হঠাৎ ভাই কোথা থেকে যেন এসে আমার পাশে দাড়ালেন।ভাইয়ের চেহারায় আলো ঝলমল করছে।অত্যন্ত আনন্দ নিয়ে ভাই আমাকে বললেন, "জানো কনক, আমি রেসিডেন্সীতে চান্স পেয়েছি, প্রতি মাসে ১০,০০০(দশ হাজার) টাকা করে পাব"। ভাইয়ের সে আনন্দ দেখে বুঝেছিলাম, ১০,০০০ টাকাটা নিছক একটা সংখ্যা ছিলো না, সেটি ছিলো দারিদ্র্যের উষ্ণতায় জর্জরিত এক মানুষের জীবনে হঠাৎ কালবোশেখীর এক শীতল হাওয়া।
সর্বশেষ খবর #শুনতে পেলাম, এখন থেকে রেসিডেন্সীতে কোন বেসরকারী চিকিৎসক আর কোন ভাতা পাবেন না। আমার সেই ভাই এখনও BSMMU রেসিডেন্সীতে আছেন।জানি না, এই খবর শোনার পর উনার মনের অবস্থা কি হয়েছিলো....

#অ্যনালাইসিস_এবং_দীর্ঘশ্বাস

এই যে, অনারারী প্রথা এখনও চলছে, আমি জানি না, এই অযৌক্তিক বর্বর প্রথা কবে, কে শুরু করেছিলেন।আপনি কি কখনোও চিন্তা করতে পারেন, আপনি একটা অশিক্ষিত লোককে ৭ দিন খাটাবেন, অথচ একটা পয়সাও দিবেন না; কোন সভ্য সমাজ এর স্বীকৃতি দিবে? প্রশ্নই আসে না। তবে কোন যুক্তিতে একজন উচ্চ শিক্ষিত চিকিৎসককে ৩ থেকে ৫ বছর, আই রিপিট, ৩ থেকে ৫ বছর, বিনা পয়সায় খাটাবেন? পোষ্ট গ্রাজুয়েশনের কোন নিশ্চয়তা তো নেই। অনেকে বলতে পারেন, কিছু তো শিখছে। আমি তাদের বলি, মেডিকেল সায়েন্সে আজ যিনি অধ্যাপক, উনিও প্রতিনিয়ত শিখছেন। মোস্ট প্রবাবলি, #William_Osler বলেছিলেন, 'যেদিন কোন চিকিৎসক মনে করবেন তিনি আর নতুন কিছু শিখবেন না, বুঝতে হবে, চিকিৎসক হিসেবে ওইদিন তার মৃত্যু হয়েছে'।কাজেই শিখানো হচ্ছে এই ধোয়া তুলে এই বর্বর প্রথা সমর্থন যোগ্য নয়। যেখানে বর্বর প্রথার সমাপ্তি হবার কথা, সেখানে এই দেশে এই প্রথার #আপসার্জ হচ্ছে।এখন রেসিডেন্সীতেও অনারারী সিস্টেমের ভুত চেপে বসার পায়তাঁরা করছে।

অনারারী ট্রেইনি যারা, তারা না ট্রেনিং এ মনোযোগ দিতে পারে, না ক্লিনিকে মনোযোগ দিতে পারে।যেহেতু একটি পয়সাও আয় নেই, অথচ তার সমতুল্য বন্ধুরা তখন কম করে হলেও হাজার পঞ্চাশেক টাকা কামিয়ে চলছে, এমন অবস্থায় ক্লিনিক এ ঢু মারতে গিয়ে ট্রেনিং এর বারোটা বাজে। ক্লিনিকগুলোতে ঢু না মারলেও তো চলে না, এই বয়সে বাসা থেকে টাকা চাওয়া যায়? বিয়ে করে ফেললে তো গোদের উপর বিষফোঁড়া।

রেসিডেন্সীটা সে হিসেবে ভালো ।হাজার দশেক টাকায়( কেটেকুটে সাড়ে আট এর মত) ডাল-ভাত আর শাহবাগের আজিজ এ এক খাট ফেলে ঘুমটা নিশ্চিন্তে করা যায়। রেসিডেন্সী ট্রেনিং এর কোয়ালিটি তাই কিছুটা Maintain হয়। এখন রেসিডেন্সী ভাতা যদি বন্ধ হয়ে যায়, তবে সেই কোয়ালিটি আর আশা করা যাবে না, কারণ তারাও এখন HMO দের মত ক্লিনিকে ধর্ণা দিবে, আগে খেয়ে পড়ে বাঁচতে তো হবে।দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এই ধোঁয়াশা খবরটি একটি অশনিসংকেত।
 
এবার কোর পয়েন্টে আসি।অনারারী ট্রেইনী ও রেসিডেন্সীদের ভাতা দিতে হবে। সব সভ্য দেশই দেয়, বাংলাদেশ ব্যতিক্রম । প্রশ্ন হলো, টাকাটা আসবে কোথা থেকে? রেসিডেন্সী হিসেবে যারা আছেন, সেই সাড়ে চার'শ মত চিকিৎসক কে তাদের ভাতা দিতে খরচ হবে বছরে মাত্র ৫.৮ কোটি টাকা।এই টাকাটা BSMMU কেই কেন দিতে হবে? যদি অনারারী সহই ধরি, তবে প্রতি বছর খরচ হবে ২০-৩০ কোটি টাকা( ধরে নিলাম)। এই টাকাটা দেয়া উচিত #সরকারের। সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী আমরা এখন মধ্যম আয়ের কান্ট্রি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪৪ তম বাজেটের আকার প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা। প্রতিবছর ২০-৩০ কোটি টাকা সেখানে নিতান্তই ক্ষুদ্র একটি সংখ্যা। এই টাকার অনুমোদন কি সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া যায় না? অপ্রয়োজনীয় বিলাস বহুল গাড়ী কিনতে হর্তাকর্তারা কোটি কোটি টাকা শুল্কমুক্ত সুবিধা পান। যে সমস্ত নবীন চিকিৎসকদের ব্যবহার করে তাদের রক্ত পানি করে জনগণকে বিনাপয়সায় স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হচ্ছে, তাদের দিকে কি সরকার এই সহানুভূতির হাতটি প্রসারিত করতে পারে না? একটি দেশ কি তার নিজের সন্তানের সাথে এমন প্রতারণা করতে পারে? এরা কি বাইরের কেউ?

১৮৬৩ সালে Abraham Lincoln মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দাস প্রথার অবসান ঘটান এবং #মুক্তি_ঘোষণা (Emancipation Proclamation) এর মাধ্যমে দাসদের মুক্ত করে দেন। প্রায় ১৫০ বছর পর সভ্য সমাজের মানুষ হয়েও আমরা সমাজের বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই প্রথাকে বিভিন্ন রঙের মুখোশ পরিয়ে টিকিয়ে রেখেছি।
"If slavery is right, it ought to be extended ; if not, it ought to be restricted, there is no middle ground." আমরা দাসপ্রথাকে Restricted করতে পারিনি, আমরা Extended করেছি।আমরা সভ্য হতে পারিনি, আমরা জাতিগতভাবে অসভ্য হয়েছি।আমরা প্রকৃত পক্ষে আধুনিক হতে পারিনি, আমরা মধ্যযুগীয় মানসিকতাকে চর্চা করে চলছি। হাজারখানেক চিকিৎসক পোষ্টগ্রাজুয়েশনের মায়াবী হাতছানির শিকলে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর বিনে পয়সায় দাসত্ব চালিয়ে যাবে। এদের দীর্ঘশ্বাসের করুণ কাহিনী অরণ্যে রোদনের মত আকাশে বাতাসে মিলিয়ে যাবে, কেউ কর্ণপাত করবে না, কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে না।

 আহারে!....আহারে!.....

>>কালেক্টেড পোস্ট<<