Thursday, August 30, 2018

একটি পাপ ও তার প্রায়শ্চিত্ত (বড় লেখা, যারা ডাক্তার হতে স্বপ্ন দেখেন মাস্ট জানা দরকার )


১.....
পড়ন্ত বিকেল।স্থানঃ অজপাড়াগায়ের এক সরকারী হাসপাতালের ইমার্জেন্সী রুম। আমার চোখের সামনে এক পেট ফোলা রোগী শুয়ে আছে, সাথে জন্ডিসও আছে। ক্লিনিক্যালী রোগীটা Chronic Liver Disease( CLD) এর একটা পেশেন্ট....
চোখ বন্ধ করে CLD এর আন্ডারলায়িং কারণ মনে করার চেষ্টা করলাম।একসময় আঙ্গুল গুণে গুণে ১১ টা কারণ একনাগারে বলতে পারতাম, সেইমুহূর্তে ৮ টার বেশী মনে করতে পারলাম না। অবশ্য তিন বছরেরও অধিক সময় একটানা যখন আমাকে গ্রামে ফেলে রাখা হয় তখন CLD এর ৮ টা আন্ডারলায়িং কারণ যে মনে আছে--সেটাই তো অনেক.....

২....
আমি তখন DMC তে পোস্টগ্র্যাজুয়েট ট্রেনিং করি। গলা ব্যথা নিয়ে এক ইয়াং পেশেন্ট হাসপাতালে আসলে Palatal petechie আর Spleenomegaly পেয়ে ডায়াগনোসিস করেছিলাম-- Infectious mononucleosis. PBF এ আগ্রহ নিয়ে Atypical lymphocyte খুঁজতাম....
স্মৃতিগুলো ছিলো মধুময়, But those days are almost gone now. গলা ব্যথার রোগী এখনও ডিল করি, তবে এখন আর টর্চ দিয়ে মুখ হাঁ করিয়ে Palatal petechie দেখা হয় না, সে সুযোগও এখন পাই না, দেখার উৎসাহও এখন আর কেউ দেয় না.....
একটা একাডেমিক চিকিৎসককে নন-একাডেমিক কোয়াক বানানোতে এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা ইউনিয়ন সাবসেন্টারগুলোর জুড়ি নেই। এইসব জায়গাগুলোতে অকাজে উৎসাহ দেবার লোক আছে, আসল কাজের উৎসাহ দেয়ার কেউ নেই....
গ্রামের এই হাসপাতালের আউটডোরের বাইরে জনা ত্রিশেক লোক লাইনে দাঁড়িয়ে তারস্বরে চেঁচাতে থাকে, বোকা এই লোকদের বোঝানো হয়েছে এখানে ফ্রি ওষুধ পাওয়া যায়, রোগ ধরা গুরুত্বপূর্ণ না, ফ্রি ওষুধটাই বড় কথা।ফ্রি ওষুধ পেয়ে এরা আবার হিসেবে বসে যে ফ্রি ওষুধের মূল্য রিকশা ভাড়ার থেকে বেশী হলো কিনা, তবেই না হাসপাতালে আসা স্বার্থক হবে। জ্বর আর গলা ব্যথায় তাই এখন P/C( প্যারাসিটামল) আর H/C( হিস্ট্রাসিন) ই আমার নিত্যসঙ্গী, দুর্বলতা বললে B/C( ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স) তো আছেই....

৩...
আমার কথা বাদ থাকুক, এক ব্রিলিয়ান্ট বড় ভাইয়ের গল্প বলি। জয়েন্ট পেইনের রোগী পেলে যে ভাই Seronegetive নাকি Seropositive সেটা নিয়ে মেতে উঠতো, Spondyloarthropathy ডায়াগনোসিস করার জন্য যে ভাই গ্রামের এই সেটিংএ Oblique view of SI joint এর এক্সরে করে সেই এক্সরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো--সেই ভাইকে ৬ বছর গ্রামে পড়ে থাকতে থাকতে এখন এসব বাদ দিয়ে জয়েন্ট পেইনের রোগী এলে অ্যানালাইসিস বাদ দিয়ে ধুন্দুমার স্টেরয়েড প্রেসক্রাইব করতে দেখি...
যে ভাইকে আগে Aspiration pneumonia তে Cephalosporin এর সাথে Metronidazole নাকি Clindamycin এর কম্বিনেশন ভালো হবে সেটা নিয়ে কথা কাটাকাটি করতে দেখেছি, সে ভাই এখন গ্রামে বসে দেদারসে যেকোন জ্বরের রোগীকে Ceftriaxone মেরে দেন, কথাবার্তাতেও এখন অনেক পরিবর্তন, ডাক্তার ডাক্তার ভাব বাদ দিয়ে কেমন যেন এখন একটা গ্রাম্য নেতার ভাবসাবও চলে এসেছে।ভাই এখন কতটুকু করাপটেড, সেটা আর নাই বা বলি, উপজেলা হেলথ্ কমপ্লেক্সে দীর্ঘদিন পড়ে থাকবেন আর করাপটেড হবেন না-সেটা আনইউজুয়াল.....

৪....
এবার একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কয়েকটা কথা বলি। উপজেলা লেভেল ও ইউনিয়ন সাবসেন্টারগুলো চিকিৎসকদের জন্য সম্পূর্ণভাবে অরক্ষিত একটি জায়গা। অশিক্ষিত ও অপশিক্ষিত লোকদের যদি আপনি সমঝে চলতে না পারেন তবে আপনার কপালে খারাপী আছে, মোরালিটি এখানে তিলে তিলে নষ্ট হবে।এহেন জায়গায় একটানা ২ বছর কষ্টকর, একটানা ৪ বছর অনেকটা অসম্ভব....
লজিস্টিক সাপোর্টের কথা আর নাই বা বলি। নলেজ আছে কিন্তু প্রয়োগ করতে পারছেন না -এর চেয়ে হতাশাজনক আর কিছু কি হতে পারে? আমার এক কার্ডিওলজিস্ট বন্ধু তো ৩৩ তম বিসিএস আর কন্টিনিউই করলো না তার পোস্টিং প্লেস এ লজিস্টিক সাপোর্ট না পেয়ে...

৫....
আমার বক্তব্য কি আপনাদের কাছে পরিস্কার হয়েছে? আপনারা কি বুঝতে পারছেন যে প্রতিটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো নবীন, কর্মোদ্যম চিকিৎসকদের জন্য একেকটা #Death_Trap?আপনারা কি জানেন যে -কোন চিকিৎসক তার জীবনের দীর্ঘ সময় উপজেলা লেভেলে থাকলে তার চিকিৎসক জীবনের মানসিক মৃত্যু ঘটে?
কথাগুলো কেন বললাম? যারা জানেন না তাদের জন্য বলিঃ বিসিএসে (স্বাস্থ্যে) নতুন নিয়ম তৈরি করা হয়েছে যে প্রতিটি চিকিৎসককে তার স্বর্ণালী জীবনের প্রথম ৪ টি বছর গ্রামে থেকে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে। আগের বাধ্যবাধকতা ছিলো ২ বছরের....

৬....
এবার একটা ছোট ক্যালকুলেশনে আসেন। ইন্টার্নীসহ MBBS কমপ্লিট করতে করতে যদি বয়স হয় ২৪, তারপরে বিসিএসের নিয়োগ ঝামেলা আরো ন্যূনতম ২ বছর, প্লাস গ্রামে চিকিৎসা সেবা ৪ বছর।অলরেডী কিন্তু ৩০ বছর গত হয়েছে। ট্রেনিং পোস্ট কিন্তু হাতের মোয়া না, আরো ১ বছর ধরলাম। তারপর ট্রেনিং প্লাস কোর্স পিরিয়ডের ঝক্কিতে আরো ৪ থেকে ৫ বছর। এবার বলুন পোস্টগ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করতে করতে বয়স কত হবে?
এদেশে চিকিৎসক হওয়াটা কি পাপ? আমাদেরকে কি এখন তার জন্য একটার পর একটা প্রায়শ্চিত্ত করে যেতে হবে?
প্রতিবার একেকটা সমস্যা হয় আর চিকিৎসক নেতৃবৃন্দ সমস্যা সমাধানে তৎপর হন। ডেপুটেশন সংক্রান্ত একটা সমস্যা হলো, তখনও একই ঘটনা দেখা গেলো, এবারো নিশ্চয়ই সেটাই হবে। সমস্যা তৈরি হবার পূর্বেই আপনারা অ্যাকশনে যান না কেন? আপনাদের সাথে পরামর্শ ছাড়া এসব ডিসিশন কিভাবে পাশ হয়?
একটা তুর্কি প্রবাদ বলি।" জঙ্গল ছোট হয়ে আসছিলো, তারপরও গাছেরা কুঠারকে ভোট দিচ্ছিলো। কারণ, কুঠারের হাতল কাঠের তৈরি আর গাছেরা ভেবেছিলো কুঠার বুঝি তাদেরই একজন..."
প্রিয় নেতৃবৃন্দ, জঙ্গল বেশী ছোট হবার পূর্বেই ব্যবস্থা নিন....
প্রমোশনের পথ রুদ্ধ হচ্ছে, দেশের কারেন্সীগুলো কিন্তু দেশের বাইরে চলে যাবে। এর ফলাফল আমার বা আপনার কারো জন্যই কিন্তু সুখকর কিছু হবে না.....

৭....
আমি কি এদেশের প্রান্তিক পর্যায়ের জনগণের চিকিৎসা সেবা প্রাপ্তিকে বাধাগ্রস্ত করছি? ব্যাপারটা কিন্তু তা না। আমি প্রান্তিক পর্যায়ে ৪ বছর চিকিৎসা সেবার পক্ষপাতী, তবে সেটা হতে হবে মেধাকে ধ্বংস না করে। ৪ বছর গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসা সেবা দেয়াটা হতে হবে প্ল্যানড্ এন্ড সিস্টেমেটিক....
৪ বছর একটানা গ্রামে চিকিৎসা না দিয়ে ২ বছর আগের মত গ্রামে চিকিৎসা দিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হোক। প্রশিক্ষণ শেষে আবার ২ বছর গ্রামে সেবা দিতে হবে। এতে করে পোস্টগ্র্যাজুয়েশন করার বাধাও থাকলো না আবার পরবর্তী ২ বছরে গ্রামের মানুষগুলো অনেকটা কনসালট্যান্ট পর্যায়ের সেবা পাবে, বিষয় কিন্তু একই, অথচ এই সিদ্ধান্তটা নিঃসন্দেহে অনেক পরিপক্ক....
আচ্ছা, যারা এরকম উদ্ভট ডিসিশনগুলো নেন, তারা কি একবারও কারো সাথে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেন? যদি করে থাকেন তবে এধরণের ডিসিশনগুলো কিভাবে আসে? আসলে ডিসিশনগুলো উদ্ভট নাকি আমার চিন্তাধারাই উদ্ভট? থমাস গ্রে অবশ্য বলেছিলেন--" Where ignorance is bliss, it's folly to be wise..." বোকার রাজ্যে ভালো কিছু চিন্তা করা তো উদ্ভট বিষয়ই হবে....

৮....
ফিজিক্সের Second Law of Thermodynamics কে বিশ্লেষণ করলে আমরা এনট্রপির ধারণা পাই। এনট্রপি মূলত বিশৃঙ্খলতার পরিমাপক। মহাবিশ্বে এনট্রপি বাড়ছে, এর অর্থ- মহাবিশ্ব চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দিনের পর দিন যেভাবে সুচারুভাবে এদেশে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উচ্চশিক্ষার পথকে রুদ্ধ করা হচ্ছে তাতে বোঝা যাচ্ছে এনট্রপি বৃদ্ধি শুধুমাত্র ফিজিক্সের টপিক না, একই কনসেপ্ট এদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানেও খাটে....
মেডিকেল সিস্টেমে এনট্রপির এই বৃদ্ধি বা বিশৃঙ্খলতা কিন্তু একটি অশনিসংকেত। অসংখ্য চিকিৎসক উচ্চশিক্ষার পথ থেকে সরে যাবে। এটি কি একটি দেশের জন্য মঙ্গলময় কিছু? চিকিৎসা বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষার পথকে কণ্টকাকীর্ণ করে একটার পর একটা যে আদেশগুলো তৈরি হচ্ছে তা একসময় আমাদের দেশের জনগণের জন্যই ব্যাকফায়ার হিসেবে কাজ করবে। সত্যিকার অর্থে যারা দেশমাতৃকাকে তার নিজের অন্তরে ধারণ করেন, তারা কিভাবে এমন আদেশ জারী করেন?

যেকোন দেশ যখন তাদের মেধাবী প্রজন্মকে সময়ের সাথে সাথে আরো শাণিত করে সেখানে আমরা এদেশে এই চিকিৎসক শ্রেণীটিকে একটার পর একটা বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে দিনের পর দিন গলা টিপে হত্যা করছি।
আচ্ছা, আমরা এমন কেন? আমরা কেন সবসময় অন্যের উন্নতিতে বাঁধার সৃষ্টি করি? অন্যের উন্নতিতে বাঁধা দেয়া যে নিজের দেশের উন্নতিতে বাঁধা দেয়া-এটা কেন আমরা বুঝতে চাই না? আমরা কেন আমাদের পরিবর্তন করতে পারি না?....

লিখেছেন ashaduz zaman kanak

Friday, August 17, 2018

মায়ের চিকিৎসার টাকা মা দিবে, আমারে বলেন কেন?!!


মনটা কদিন ধরেই ভালো নেই।
অবশ্য যে অদ্ভুত দেশে বসবাস করি সেদেশে মনমেজাজ একটানা ভালো থাকবে সেটাও অস্বাভাবিক। মন খারাপ হলে আপনারা কে কি করেন সেটা জানি না, তবে আমি কি করি-সেটা বলতে পারি। প্রথমেই মোবাইলটা অফ করি, মাঝে মাঝে রমনা পার্কের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে বসে থাকি, কিছু বাদাম ছড়িয়ে দিলে দুয়েকটা কাঠবিড়ালী চলে আসে, এরা কি আশ্চর্য সুন্দরকরে বাদামগুলো দুহাতে ধরে নিয়ে খায়! এদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনটা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসে।



মন খারাপের ব্যক্তিগত নানা ঘটনা বাদ থাকুক, চিকিৎসক হিসেবে যে কারণে মন খারাপ -সে ঘটনাটা বলি...


সেই দিনটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। সকাল সকাল এক যুবক সাথে করে এক বয়স্ক মহিলা ও এক তরুণীকে নিয়ে আমার চেম্বারে প্রবেশ করলেন। বয়স্ক মহিলাটি হাই-প্রেশারের রোগী, বিষয়টা নিয়ে যুবক ও তরুণী বেশ উদ্বিগ্ন। প্রেশার চেক করলাম, একটু বাড়তির দিকে। বয়স্ক মহিলাটি প্রেশারের ওষুধ খাচ্ছেন, ডোজটা বাড়িয়ে দিয়ে কি করতে হবে আর কি করা যাবে না সে ব্যাপারে কিছু কথা বলে রোগীটি দেখা শেষ করলাম। যুবকটি আমার প্রতিটা কথা বেশ দায়িত্ব নিয়ে বুঝে নিলেন, আমার সামনেই বেশ তরল গলায় বয়স্ক মহিলাকে কয়েকবার "মা, মা" ডেকে তাকেও বুঝিয়ে দিলেন। তাদের কথোপকথনে বুঝতে পারলাম বয়স্ক মহিলাটি তার শাশুড়ি, তরুণীটি তার স্ত্রী।

যুবকের রেসপনসিবিলিটিতে আমিও তখন বেশ মুগ্ধ, এমনকি মহিলার সামনেই বলে ফেললাম, 'আপনার ভাগ্য তো বেশ ভালো! এমন জামাই কি সবার ভাগ্যে জোটে?'
মহিলা ও তরুণী হাসিমাখা মুখে সেটা স্বীকারও করে নিলেন।

যুবকটি ভিজিট দিয়ে বের হয়ে যাবার সময় আমাকে জানালেন ঘন্টাখানেক পর যুবকটির মা'ও আসবেন, আমি যেন একটু দেখে দেই...
যুবকটির মায়ের কথা রোগী দেখতে দেখতে ভুলে গেলাম। চেম্বার শেষ করে উঠতে যাবো, এমন সময় এক বৃদ্ধ মহিলা রুমের দরজা ও দেয়াল ধরে ধরে আমার রুমে ঢোকার চেষ্টা করলেন। আমার মনে আছে ঐ বৃদ্ধা বেশ দুর্বল ছিলেন, উনাকে চেয়ারে বসানোর জন্য আমাকে উঠে যেতে হয়েছিলো।

 এই বৃদ্ধা আসলে ঐ যুবকটির মা। ডায়াবেটিস, হাই প্রেশার, শ্বাসকষ্ট আগে থেকেই ছিলো, ইদানিং পায়ে পানি চলে আসছে, সে কারণেই ডাক্তারের কাছে আসা। অনিয়মিতভাবে চিকিৎসা নিতেন। প্রেসক্রিপশনে ওষুধ লিখে কিডনী সংক্রান্ত দু'তিনটা পরীক্ষা দিতে হলো। ভিজিট দেবার সময় উনি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন, অবাক হয়ে বলেছিলেনঃ " আমার বাজান কি টাকা দিয়া যায় নাই!"
আমাকে বলতে হয়েছিলোঃ " আপনার ছেলের মনে হয় ভুল হয়েছে। সমস্যা নেই, পরেরবার আসলে আপনার ছেলে থেকে নিয়ে নিব..."
তবে ছেলে যে ভুল করেনি সেটা পরে বুঝতে পেরেছিলাম। বুঝতে পেরেছিলাম ছেলের ভিজিট না দেয়াটা ছিল ইচ্ছাকৃত...

মাসদুয়েক পর যুবক আবারও এসেছিলেন তার শাশুড়িকে নিয়ে, আগের মতই শাশুড়ির চিকিৎসা নিয়ে তিনি ছিলেন বেশ উদ্বিগ্ন। চলে যাবার সময় একান্তে ডেকে তার মায়ের ভিজিটের কথা বললাম।
 উনি উষ্মার স্বরে যে উত্তর দিয়েছিলেন সেটা আপনাদের শোনাইঃ "মায়ের চিকিৎসার টাকা মা দিবে, আমারে বলেন কেন?"
অপেক্ষাকৃতভাবে সুস্থ শাশুড়িকে নিয়ে স্ত্রী সমেত যুবকটি হাজির হতে পারলেও ছানি পড়া অধিকতর দুর্বল নিজের জন্মদাত্রীকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসার সময় যুবকটির হয় নি। শাশুড়ির ক্ষেত্রে ভিজিট দিতে যুবকটি কার্পণ্য করেনি, কৃপণতা তিনি দেখিয়েছেন তার জন্মদাত্রীর প্রতি...

বৃদ্ধা মহিলা পরবর্তীতে আরো দু'বার সম্পূর্ণ একা একাই আমার কাছে এসেছিলেন, একা না এসে উপায়ও নেই, স্বামী মারা গিয়েছে অনেকদিন আগে। ততদিনে পায়ের ফোলা আরো বেড়েছে, তেমন কোন ওষুধও নেন নি, পরীক্ষাগুলোও করান নি। কেন ওষুধ ঠিকমত নেন না জিজ্ঞেস করাতে বলেছিলেনঃ" বাজান তো ওষুধ কিন্যা দেয় না। ওর কি দোষ কন! বউ-বাচ্চা নিয়া কত খরচের সংসার!"

বৃদ্ধা এর পরে যে দু'বার এসেছিলেন সে দু'বারই সর্বমোট ২০০-৩০০ টাকা হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছিলেন, আমার ভিজিটটাও দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, "বাজান" কে হয়ত ভিজিট সংক্রান্ত ব্যাপারে ডাক্তারের সামনে আর অপমানিত হতে দিতে চান নি। আমার সাথে বৃদ্ধার আর দেখা হয় নাই...

এসব ঘটনার পর সাত-আট মাস পার হয়েছে। গত শুক্রবার ঐ যুবক আবারো তার শাশুড়ি আর স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিলেন। শাশুড়ি সংক্রান্ত ব্যাপারে উনার তৈলাক্ত ভাব আরো বেড়েছে। প্রেসক্রিপশন লেখা শেষে কৌতুহল বশত একবার জিজ্ঞেস করলাম: 'আপনার মা কেমন আছেন?' উনি আনন্দিত চেহারা নিয়ে বললেন (I repeat, উনি আনন্দিত চেহারা নিয়েই কথাটা বলেছিলেন): "মা তো মারা গেছে আরো মাস চারেক আগে! মারা গিয়া অবশ্য ভালোই হইছে, তার জন্যে সবার অনেক কষ্ট হইতেছিলো"


আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো, ক্ষণিকের জন্য থমকে গেলাম।
 আহারে! যে মা তাকে "বাজান" ছাড়া কখনও সম্বোধন করেন নাই, সেই "বাজানে"র কথাটা কি ঐ মা পরপার থেকে শুনতে পেয়েছেন? ঐ মা কি শুনতে পেয়েছেন যে মৃত্যুর আগমুহূর্তে তার জন্য নাকি সবার কষ্ট হচ্ছিলো? "বাজান"-কে কষ্ট থেকে মুক্ত করতেই কি তিনি তাড়াতাড়ি ওপারে চলে গেলেন? আমার চিন্তার রাজ্য কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেলো। প্রেসক্রিপশন নিয়ে বৃদ্ধার ছেলে হাসিমুখে তার শাশুড়িকে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। মনে অনেক কথা ছিলো, মুখে কিছু বলতে পারলাম না। ক্লান্ত পথিকের মত ঝিম মেরে তাদের গমন পথের দিকে চেয়ে রইলাম, পথিক শুধু দেখে যায়, কিছু বলা তার শোভা পায় না...

চিকিৎসক হিসেবে সবচেয়ে কঠিন কাজ কি জানেন? মানুষের সাথে সাথে মানুষরূপী কিছু অমানুষের চিকিৎসাও আমাদের করতে হয়। সে বড় কঠিন কাজ! চিকিৎসকদের আপনারা পশু বলেন, অমানুষ বলেন--তাতে এখন খুব একটা কষ্ট পাই না, আপনারা মানুষ থাকলেই আমরা অনেক খুশি। দিনের পর দিন শত-সহস্র সত্যিকার "মানুষ"দের চিকিৎসা দিতে আমরা চিকিৎসকরা কিন্তু ক্লান্ত হই না, "মানুষরূপী অমানুষ"দের চিকিৎসা দিতে আমাদের যে বড্ড কষ্ট হয়...
লিখেছেন ঃডাঃ জামান অ্যালেক্স