Tuesday, December 11, 2018

নতুন বাংলাদেশকে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুতি নেন...

যে দিনটায় ভিকারুন্নিসার শিক্ষিকা গ্রেপ্তার হলেন সেই দিনটা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য খুব একটা কষ্টের দিন। এই দিনের আগের বাংলাদেশ, আর এই দিনের পরের বাংলাদেশ এক হবেনা। বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজের কাছে খুব ভয়ের একটা মেসেজ গেলো যে নকল ধরলে এমন পরিণতিও হতে পারে। 

এইযে ডাক্তার পেটানো শুরু হয়েছিলো বাংলাদেশে, এতে একটা ক্ষতি হয়েছিলো আপনারা নিজেরা টেরও পান নাই। এখন গ্রামের দিকের ডাক্তারেরা একটু ক্রিটিক্যাল ইমার্জেন্সী রোগী হলেই তাদের শহরে রেফার করে পাঠিয়ে দেন, কোন ঝুঁকি নেন না নিজেরা চিকিৎসা করার। কারন রোগীর কিছু একটা হয়ে গেলে পরে মানুষ ডাক্তারের উপর চড়াও হবে। একজন রোগীকে সদরে রেফার করে দেয়ার অধিকার ডাক্তারদের আছে। এতে করে দেখা যায় অনেক রোগীর হয়তো তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিলে উপকার হতো, কিন্তু শহরে যেতে যেতে রোগীটা সেই চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়, অনেক সময় মারাও যায়।

এই গ্রেপ্তার বাংলাদেশের শিক্ষকদেরও তেমনই একটা মেসেজ দিলো। নকল টকল ধরলে তাদের জেলে যেতে হবে, কি দরকার তাহলে ঝামেলা করার! কেউ চুপে চুপে নকল করলে তো তার কোনকিছু আসে যায়না। সবার আগে নিজের জীবন বাঁচানো ফরজ। এইযে ভিকারুন্নিসার তিন শিক্ষিকা ফেঁসে গেলেন, তারা যদি মেয়েটার হাতে ফোন দেখেও কিছু না বলে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতেন তাহলে কি তাদের আর এই বিপদে পড়তে হতো? কেউ তাদের ফাঁসি আর দশ বছরের কারাদন্ড দাবি করতো?

শিক্ষকেরা পরিস্থিতি ওয়াচ করছেন। এক প্রকার ধরেই নেয়া যায় শিক্ষকেরাও ডাক্তারদের মতোই নিরব বিপ্লবের দিকেই আগাবেন। যাদের কাজ জাতির মেরুদন্ড সোজা করা তাদের নিজেদের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়ার জন্য ছাত্রদের এত তৎপরতা দেখে যদি তাদের ক্ষোভ জন্মে তাতে কি তাদের খুব একটা দোষ দেয়া যায়? তখন যদি ছাত্রদের মেরুদন্ড গড়ার বদলে যদি শিক্ষকেরা ছাত্রদের ভেতর ঘুণপোকা ঢোকানোর আয়োজন করেন তাহলে কিছু কি করার আছে? ছাত্রছাত্রী আর অভিভাবকেরা যে রকম প্রতিহিংসা দেখাচ্ছেন শিক্ষকদের প্রতি, তার একশো ভাগের একভাগও শিক্ষকেরা নিরবে দেখানো শুরু করেন দশ পনেরো বছর পর একটা জাতিকে হারিকেন দিয়েও আর খুঁজে পাওয়া যাবেনা।

এবং তা ই ঘটতে যাচ্ছে আসলে। সামনে হয়তো টিচাররা নকল করতে দেখলেও না দেখার ভান করবেন, পড়া শিখে আসলো বা না আসলো কিছুই বলবেন না ছাত্র যদি মনে কষ্ট পায় তা ভেবে, হয়তো অভিভাবককেও আর পারতপক্ষে ডাকবেন না। কিসের এত ঠেকা তাদের, বেশী আদর্শ দেখাতে গেলে কি হয় তা তো তারা অলরেডি জেনেছেন! আপনারা যে তাদের টাকা দিয়ে রাখা কাজের লোকের মত করে বিবেচনা করছেন, তারাও হয়তো তখন ছাত্রছাত্রীদের কাস্টোমার হিসেবেই বিবেচনা করবেন। সেধে এখন যেটুকু এফোর্ট দেন তখন হয়তো তা আর দিবেন না। তাদের কাজ ক্লাশ নেয়া পরীক্ষা নেয়া, তারা তা নিবেন, কেউ পড়ে আসলো কি না কিংবা নকল করে পরীক্ষা দিলো কিনা তা আর কেয়ার করবেন না। শিক্ষাব্যবস্থায় এসবের ফলাফল কি হবে আপনারা নিজেরাই বুঝুন!

এই গ্রেপ্তারের দিনটা ছাত্র ছাত্রীদের মনোভাবও পালটে দিবে। তারা আর শিক্ষকদের পাত্তাও দিবেনা। তারা জানবে দুই পয়সার কাজের লোকের মত শিক্ষককেও চাইলেই ছাঁটাই করে দেয়া যায়, জেলে পুরে দেয়া যায়। এবং এতে ডিজিটাল নকলসহ সব ধরনের নকলই উৎসাহিত হবে। কারন বাংলাদেশের জনগণ রায় দিয়েছে নকলের শাস্তি হওয়া উচিত মাথায় হাত বুলিয়ে বলা- বাবু আর এমন করো না! তারা জানবে সেটাই সঠিক, সেটাই তাদের অধিকার। আগে শিক্ষকেরা পরীক্ষার হলে গার্ড দিতেন, আর এখন থেকে বেঞ্চে বেঞ্চে গিয়ে শুধু সবাইকে বলবেন বাবুসোনা এমন করেনা! সামনের বেঞ্চ থেকে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে পেছনের বেঞ্চে যাবেন, পেছনের বেঞ্চে যেতে যেতে দেখবেন সামনের ছাত্রছাত্রীরা আবার অন্য পকেট থেকে নকল বের করে লেখা শুরু করেছে। জিনিসটা একটু ফানি শোনাচ্ছে, কিন্তু প্রিটিমাচ বিষয়টা ঠিক এই রকম যদি না ও হয় এর কাছাকাছি কিছুই হবে!

অনেক তো বিপ্লব করলেন। অনেক মানবতার বাণী শোনালেন। এখন এই নতুন বাংলাদেশকে গ্রহণ করার জন্য আপনারা প্রস্তুতি নেন...
©Shuvo Kamal

Saturday, December 8, 2018

ছেলে যে কোথাও চান্স পেল না!

আনিসুল হক
‘আমার ছেলে যে কোথাও চান্স পেল না? এখন আমি কী করব?’

এক মা তীব্র হতাশায় জর্জরিত হয়ে আমাকে ফোন করেছেন। আমি অবশ্য ফেসবুকে তাঁর কর্মকাণ্ড দেখতে পাচ্ছিলাম। তিনি তাঁর উচ্চমাধ্যমিক পাস ছেলেকে নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছিলেন। চট্টগ্রামে যেদিন যান, সেদিন কী কারণে গাড়িঘোড়া চলছিল না, তাঁরা বহু কষ্টে ট্রেনে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাতে সক্ষম হন। তাঁরা সিলেটে গেছেন, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে, জাহাঙ্গীরনগরে গেছেন—এসব দেখছি। শেষে পেলাম তাঁর সেই ফোন কল, ‘আমার ছেলেটা যে কোথাও চান্স পেল না!’

তারপর বললেন, ‘জানেন, ওর খুব শখ ছিল, আইবিএ পড়বে, আমি আর ও সারা রাত একসঙ্গে অঙ্ক কষেছি...হলো না। আসলে আমি ওকে জোর করে ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং করিয়েছিলাম, ওর তো ইচ্ছা ছিল না, তবু...।’
আমি বললাম, ‘কোথাও চান্স পায়নি, বেসরকারি ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও না?’
‘চান্স পেয়েছিল। ও বেসরকারিতে পড়বে না।’

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাওয়া এক শিক্ষার্থীর মায়ের এ কথাগুলো থেকে কতগুলো সূত্র আপনা–আপনি চলে আসে।
ছেলে পড়তে চায় ব্যবসা, মা পড়াতে চান ইঞ্জিনিয়ারিং। মা-বাবা কী চান, এটা একদমই বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, শিক্ষার্থী নিজে কী পড়তে চায়। কী করতে তার ভালো লাগে। যার যা করতে ভালো লাগে, যে যা পড়তে চায়, যে যা হতে চায়, তাকে তা-ই পড়তে দিন, তা-ই হওয়ার জন্য লড়াই করতে দিন।

এ কথা সবাই বলেছেন। সব সময় বলেন।

 এই তো সেদিন কিশোর আলোর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন সাকিব আল হাসান। তিনিও একই কথা বললেন কিশোরদের, ‘তোমাদের যা করতে ভালো লাগে, সেটা মন দিয়ে করো।’

বিশ্ব দাবায় চ্যাম্পিয়ন হওয়া ভারতীয় বিশ্বনাথন আনন্দ ভারতের পত্রিকা টেলিগ্রাফ–এ এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন সফল হওয়ার সূত্র, ‘আপনি যা করেন, তা আপনার পছন্দ করতে হবে। আপনি সেটা করতেই থাকবেন। হাল ছাড়বেন না। অনেক কষ্ট হবে, অনেক ব্যর্থতা আসবে। কিন্তু আপনি যেহেতু জিনিসটা পছন্দ করেন, কষ্ট–ব্যর্থতা আপনার কাছে কঠিন কিছু মনে হবে না।’


জীবনটা সন্তানের। বাবা-মায়ের নয়। আমরা যারা বাবা-মা, তারা তাদের অপূর্ণ ইচ্ছাটা সন্তানের ওপর চাপিয়ে দিই। প্রত্যাশার ভারে সন্তানের জীবনটাকে শ্বাসরোধী করে তুলি। এটায় হিতে বিপরীত হওয়ার শঙ্কা থাকে বেশি।

দুই নম্বর কথা হলো শিক্ষার্থীরও একটা স্বপ্ন থাকতে পারে। লক্ষ্য থাকতে পারে। এই স্বপ্ন পূরণ না–ও হতে পারে। বিশেষ করে কী পড়ব, কোথায় পড়ব, কোথায় ভর্তি হব, এসব নিয়ে সবার স্বপ্ন পূরণ হবে না। এটা একটা গাণিতিক বাস্তবতা। প্রায় ৮ লাখ ৫৮ হাজার ছেলেমেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেছে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন আছে প্রায় ৫০ হাজার। সহজ হিসাব হলো, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবে না আট লাখের বেশি ছেলেমেয়ে। তেমনিভাবে এ বছর প্রায় চার লাখ তরুণ–তরুণী বিসিএস পরীক্ষায় বসছে, কিন্তু পদের সংখ্যা মাত্র এক হাজার। তার মানে ৪০০ জনে একজন বিসিএসে উত্তীর্ণ হবে। ৩ লাখ ৯৯ হাজারেরই প্রত্যাশা ভঙ্গ হবে। তাই বলে এই বিপুলসংখ্যক যুবকের জীবন শেষ হয়ে যাবে?

এ পি জে আবদুল কালাম হতে চেয়েছিলেন বিমানবাহিনীর পাইলট। দেরাদুনে গেছেন ভর্তি পরীক্ষা দিতে। আটজন নেবে, তিনি হলেন নবম। মন খারাপ করে নদীর ধারে বসে আছেন তিনি। এই সময় এক সাধু এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি অন্ধকারে নদীর ধারে একা বসে আছো কেন?’
‘আমার জীবন ব্যর্থ হয়ে গেছে। এই জীবনের কোনো মানে নেই। আমি বিমানবাহিনীর ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেছি।’
সাধু বললেন, ‘তুমি ওঠো। এর মানে এই যে নিয়তি তোমার জন্য বিমানবাহিনীর পাইলট হওয়া ঠিক করে রাখেনি। তুমি অন্য কিছু হবে, তাই ঠিক করে রেখেছে। তুমি তোমার নিয়তিনির্ধারিত গন্তব্য অনুসরণ করো।
 তুমি সফল হবে।’
এ পি জে আবদুল কালাম ভারতের বিখ্যাত বিজ্ঞানীই কেবল হননি, ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন।

তিন নম্বরে আমার বলার কথাটা হলো, সন্তানের লড়াই সন্তানকেই করতে দিন। চামচে করে তুলে তাকে খাওয়াবেন না। আমার আব্বা মনীষী-উক্তি আওড়াতেন, শিশুকে প্রকৃতির কোলে ছেড়ে দাও, প্রকৃতিই শিশুকে শিক্ষা দেবে।
এবার জীবন সম্পর্কে আমার প্রিয় দুটো উক্তি আমি আবারও বলে নিতে চাই। আইনস্টাইন বলেছেন, ‘জীবন হলো বাইসাইকেলের মতো, সব সময়
চালাতে হয়, তা না হলে পড়ে যেতে হয়। চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, প্যাডেল ঘোরাতে হবে, থামা যাবে না।’ আর দ্বিতীয় কথাটা বলেছেন আমেরিকান কবি রবার্ট ফ্রস্ট, ‘জীবন সম্পর্কে আমার সমস্ত অভিজ্ঞতা আমি মাত্র তিনটা শব্দে বলে যেতে পারি—জীবন চলেই যায়।’

প্রতিটা জীবন সুন্দর। প্রতিটা জীবন অর্থপূর্ণ। প্রতিটা মানুষ এই পৃথিবীতে একটা আলাদা তাৎপর্য নিয়ে এসেছে, সাফল্যে–ব্যর্থতায় আশায়–আনন্দে দুঃখে–তাপে তা চরিতার্থতা লাভ করে। আমাকে ডাক্তার হতেই হবে, আমাকে ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে, এই জেদের কোনো মানে হয় না। পারফেকশনিস্ট বা শুদ্ধতাবাদী হওয়ারও কোনো মানে হয় না। এই প্রকৃতিতে কোথাও কোনো সরলরেখা নেই। একটা জিনিসও দেখাতে পারবেন না, যেটা প্রকৃতি বানিয়েছে, কিন্তু যা সরলরেখার মতো সোজা। হতেই পারে না। প্রকৃতি পারফেকশন বা নির্ভুলতা বা ছাঁচে ফেলা জিনিস তৈরি করে না।
আমাদের দেশে প্রতিবছর ২০ লাখ শিশু জন্ম গ্রহণ করে। গত বছর ১০ লাখের বেশি মানুষ বিদেশে গেছেন কাজ নিয়ে। উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছে সাড়ে আট লাখ। জানি, বিদেশে গিয়ে আমাদের অভিবাসীরা অনেক কষ্ট করেন, তারপরও তাঁরাই সব মানুষের সেরা মানুষ, তাঁরাই তো এ দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাচ্ছেন। আর এক হাজার বিসিএস ক্যাডার আর নানা ধরনের সরকারি-বেসরকারি চাকরি করে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। কিন্তু তার বাইরে আছে আরেক দল সোনার মানুষ। কৃষিতে, শিল্পে, ব্যবসায়িক উদ্যোগে, তথ্যপ্রযুক্তিতে দেশে সৃষ্টিশীলতা আর উৎপাদনশীলতার বন্যা বইয়ে দিচ্ছে কোটি কোটি নাম না জানা মানুষ।
এই দেশের মাটি বড়ই উর্বর। এই দেশে ইটের দেয়ালে বীজ পড়লে গাছ হয়, সেই গাছ বড় বড় পাতা মেলে ধরে। এই দেশে ব্যবসায়, বাণিজ্যে, শিল্প-উদ্যোগে, কৃষিতে, আইটিতে, চিকিৎসায়, শিক্ষায় কত–কী যে করার আছে, কত–কী যে মানুষ করছে।
এক ভারতীয় গুরুর বক্তব্য ইউটিউবে পাই; তিনি হাসতে হাসতে বলেছেন, ১. ক্লাসে যারা সবচেয়ে ভালো ফল করে, তারা হয় ডাক্তার–ইঞ্জিনিয়ার। ২. তাদের পরে যারা ভালো করে, তারা হয় সরকারি কর্মকর্তা। কাজেই এক নম্বর গ্রুপ থাকে দুই নম্বরের অধীনে। ৩. এরপর যারা ভালো করে তারা করে ব্যবসা। ১ নম্বর, ২ নম্বর গ্রুপ থাকে ৩ নম্বরের অধীনে। ৪. এরপরের ছাত্ররা আসে রাজনীতিতে। হয় নেতা। ১,২ আর ৩ নম্বর গ্রুপ থাকে ৪ নম্বরের অধীনে। ৫. যারা ফেল করে তারা হয় ডন, গডফাদার। ১,২, ৩,৪ নম্বর গ্রুপ থাকে ৫ নম্বরের অধীনে। ৬. আর এদের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়ার দলে আছে আমার মতো গুরু আর সাঁইজিরা। আমরা সবাইকে উপদেশ দিই। ১, ২, ৩, ৪, ৫—সবাই থাকে আমাদের অধীনে।
Collected Post