Sunday, November 26, 2023

যারা মেডিকেলে পড়ার চিন্তা করছো,তাদের জন্য কিছু বাস্তব উপদেশ

 ইন্টারমেডিয়েট এ পড়া ছোট ভাইদের জন্য এই লেখাটা লিখছি। 

যারা মেডিকেলে আসার চিন্তা করছো, 

তাদের জন্য স্পেসিফিক ভাবে যদি তোমাদের একদম মনের ইচ্ছা, সেই লেভেলের প্যাশন যে মেডিকেল সাইন্স নিয়ে পড়বে, ভয়ানক লেভেলের আগ্রহ, বায়োলজি খুবই এনজয় করো- তবে মেডিকেলে আসতে পারো। 

আর যদি এমন হয় যে- এই ধারণা নিয়ে আছো যে- মেডিকেলে একবার ঢুকলেই লাইফ সেটেল, প্যারা নাই, ফুল চিল, লাইফ/ফিউচার জিংগালালা, পাশ করলেই খালি টাকা আর টাকা, তাহলে বলবো- ছোট ভাই, আইসো না। 

 একটা কমন প্রশ্ন, সেকেন্ড টাইম দিবো নাকি দিবো না?

আমি মনে করি লস প্রজেক্ট। খুব সিরিয়াস আগ্রহ থাকলে + ফ্যামিলি সাপোর্ট থাকলে ট্রাই করা যেতে পারে, আদারওয়াইজ আমি ডিস্কারেজ করবো।

 সরকারি মেডিকেলে পড়বে নাকি প্রাইভেট?

 আমার পারসোনাল অপিনিওন হলো- দেশের প্রথম সারির ১০-১২ টা মেডিকেলের মধ্যে হলে আসো, আদারওয়াইজ দরকার নাই। প্রাইভেটের ব্যাপারে বলবো যে ফ্যামিলি খুবই সলভেন্ট/রিচ হইলে, পাশ করার পর ফ্যামিলি কে সাপোর্ট দেওয়া লাগবে না, এমন যদি হয় + নিজের ভয়ানক আগ্রহ থাকে- তবে প্রাইভেটে আসতে পারো, তাও টপ ৪/৫ টা প্রাইভেট এ হলে আসো, আদারওয়াজ আসার দরকার নাই। 

কিছু জিনিস মাথায় রাখা জরুরী 

 ১. মেডিকেলের বইপত্রের দাম বেশি। অন্যান্য ভার্সিটির চেয়ে খরচ বেশিই হবে এখানে। 

২. ১ম বছরেই বোন্স কেনা লাগবে। এটা আসলে বেচতে পারবে না, বোন্স বেচা আসলে হারাম। আমরা বাধ্য হয়ে কিনি, তবে শরয়ী ভাবে বেচা নিষেধ। সর্বোচ্চ দান করে দিতে পারো। ইভেন আমার ছোট ভাইও দানই করে দিসে, যদিও তাকে অনেক টাকা দিয়েই ফুল সেট কিনতে হইসে।

 ৩. মেডিকেলে পড়া অবস্থায় টিউশন করে কাপায় দেওয়া + পড়ালেখা ঠিক রাখা খুবই ডিফিকাল্ট। পড়ালেখা ঠিক রেখে একটা থেকে দুইটার বেশি টিউশন করানো যায় না। বেশি করলে নিজের পড়ার বারোটা বাজে।

 ৪. মেডিকেলের পড়া ৫ বছর আন্ডারগ্র্যাড ,এরপর এক বছর ইন্টার্নশিপ, এরপর আসলে পোস্ট গ্র্যাডে এন্ট্রি আরকি নেওয়ার জন্য আরেক নতুন সংগ্রাম, সেটায় এন্ট্রি নেওয়া, পাশ করে বের হওয়া৷ বিশাল ধাক্কা। ধরে নাও এভারেজ ১২-১৫ বছরের স্ট্রাগল।

 ৫. মেডিকেল হলো দিল্লীকা লাড্ডু। যারা চান্স পায় তারাও কাঁদে, যারা পায় না, ওরাও কাঁদে৷ বাস্তবতা জেনে বুঝে এরপর আসো। সবচেয়ে ভালো হয় যে- যদি জেনুইন আগ্রহ থাকে, তবেই আসো। আদারওয়াইজ দরকার নাই।

সংগৃহীত লেখা( ফেসবুক হতে)

Wednesday, April 5, 2023

আপনার সন্তানের নামের পাশে ডাক্তার লেখার মোহ থেকে বের হয়ে একবার শান্তভাবে চিন্তা করুন।

সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তি প্রায় শেষ। এদেশে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা, পরীক্ষার রেজাল্ট এবং সরকারি মেডিকেলে চান্সপ্রাপ্তদের নিয়ে যে উচ্ছ্বাস, সেটা অভাবনীয়। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের আমজনতা থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারণী লেভেলে এই ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে এতো ক্রেজ অথচ ডাক্তারদের নিয়ে উন্নাসিকতা আছে কিনা জানি না।

আজকের এই লেখাটি অবশ্য অন্য প্রসঙ্গে। 

অনেকেই হয়তো খেয়াল করেছেন, এবারের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার শিক্ষার্থী। এর মধ্যে পাস করেছেন প্রায় ৮০ হাজার শিক্ষার্থী। সরকারি মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন ৪ হাজার ৩০৫ জন। বাকি প্রায় সাড়ে ৭৫ হাজার শিক্ষার্থী সারা দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তির যোগ্য। 

আজকের লেখাটা মূলত সাড়ে ৭৫ হাজার শিক্ষার্থীদের জন্য। যারা সরকারি মেডিকেলে টিকেনি, কিন্তু পাস করেছেন এবং বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মালিক পক্ষের সম্ভাব্য ছাত্র হওয়ার অপেক্ষায় আছেন, তাদের অভিভাবকদের জন্য। আপনার সন্তানকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি করানোর আগে আরও একবার চিন্তা করুন।

গতবছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য সরকার ২০ লক্ষ টাকা ঠিক করে দিয়েছিলো। এই বছর এই অংকটা আরও বাড়বে। যারা বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়েন, তারা জানেন আইসবার্গের ভাসমান অংশের মতোই এই টাকা হচ্ছে দৃশ্যমান অংশ। এই টাকা দিয়ে কেউই বেসরকারি মেডিকেল থেকে পাস করে বের হতে পারবেন না। এর বাইরেও নানা ধরনের ফি যুক্ত হয়ে এই খরচ ত্রিশ লাখ পেরোবে।

এখন প্রিয় অভিভাবক, এই ত্রিশ লাখ টাকা দিয়ে আপনার সন্তানের নামের পাশে ডাক্তার লেখার মোহ থেকে বের হয়ে একবার শান্তভাবে চিন্তা করুন। কেন, আপনি সন্তানকে চিকিৎসক বানাতে চান। যাবতীয় আদর্শিক বাকোয়াজ আর ছোটবেলার রচনার কথা ভুলে আপনি যদি সৎ হন, আপনি স্বীকার করবেন, স্রেফ স্বচ্ছলতার জন্য, সম্মানের জন্য।

এদেশে কালকে যদি কেউ আবিষ্কার করে পালি কিংবা সংস্কৃত পড়ালে প্রচুর টাকা আর সম্মান মিলবে, দলে দলে সন্তানদের সবাই পড়াবে। 

সম্মানের কথাতো আপেক্ষিক বিষয়। তারপরও অনলাইনে চিকিৎসকদের নিয়ে যে, মুখরোচক আলোচনা হয় আর আপনার কাছের ডাক্তার আত্মীয়কে শুনিয়ে শুনিয়ে অধিকাংশ চিকিৎসকের নামের আগে যেভাবে কসাই বসিয়ে দেন, তাতে সম্মান কতটুকু আছে, অনুমান করে নিন। বাকী বিষয়টাতে আসি। আপনার আদরের সন্তানকে এতো টাকা খরচ করিয়ে পড়ানোর পরে তার বেতন কতো হবে জানেন?

ছয় বছর আগে, যেসব অভিভাবক ত্রিশ লাখ টাকা খরচ করে সন্তানকে ডাক্তারি পড়তে পাঠিয়েছিলেন, বেসরকারি হাসপাতালে তাদের এখন বেতন ১৫ হাজার থেকে ২৫ হাজারের মধ্যে।

 তিন বছর আগে আমি যখন বের হই, তখনও এই বেতন ছিল, এখনও এই বেতন।

 পৃথিবীতে অনেক পরিবর্তন ঘটবে,  সম্ভব, সবই সম্ভব। 

শুধু একটা ব্যাপার আমি জানি অসম্ভব।

 সেটা হচ্ছে, বাংলাদেশে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কর্তব্যরত ডাক্তার নামক যে, অসম্মানের মধ্য দিয়ে তরুণ চিকিৎসকরা যাচ্ছে, তার কোনো পরিবর্তন হবে না। আগামী তিন বছর পরেও তাদের বেতনের তেমন কোনো হেরফের হবে না।

সরকারি মেডিকেলে আমরা যারা পড়ে এসেছি, তাদের জন্য এটা মেনে নেওয়াটা সহজ। কারণ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ছেলে যে, টাকা দিয়ে পড়াশোনা করেছে, আমিও মোটামুটি একই খরচে পড়াশোনা করেছি। কষ্টটুকুর কথা আপাতত ভুলে গেলাম। কষ্ট ভুলে যাওয়া অনেক সহজ। কিন্তু মধ্যবিত্ত (আসলে বেসরকারি মেডিকেলে পড়ুয়া অধিকাংশ ছাত্রই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকেই আসে) পরিবারের ত্রিশ লাখ টাকা খরচ করে পড়া চিকিৎসক তরুণের সামনে যে, অনিশ্চয়তা পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকে, সেটা উপেক্ষা করা সহজ নয়।

বেসরকারি মেডিকেলে পড়তে থাকা এবং পড়া শেষ করে ডাক্তার হয়ে বের হয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েশনের দীর্ঘ বন্ধুর পথে খাবি খেতে থাকা অনেক তরুণের সাথে আমার পরিচয়। এদের মধ্যে অনেকেই প্রচন্ড মেধাবী। অনেকেই কষ্ট করে তাদের এই প্যাশান এবং ভালবাসার পেশাটায় সফলতার জায়গা তৈরি করে নিচ্ছেন।

 কিন্তু অধিকাংশই পারছেন না।

 প্রচুর ধার দেনা করে ফ্রি ভিসায় মধ্যপ্রাচ্য গিয়ে গ্রামের তরুণটি দেখে তার চাকরি নেই।
যে দালালের হাত ধরে সে বিদেশে এসেছে, সে পকেটে কয়েক দিনার ঢুকিয়ে দিয়ে সটকে পড়েছে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পরিবারের সঞ্চিত এবং কষ্টার্জিত ত্রিশ লাখ টাকা খরচ করে যে তরুণ চিকিৎসক বের হয়, তার চোখে মধ্যপ্রাচ্যে দালালের হাতে প্রতারণার শিকার হওয়া তরুণটির চাইতেও আমি বেশি অনিশ্চয়তা এবং হতাশা খেলা করতে দেখেছি। দালালটি অন্তত পকেটে কিছু টাকা দিয়ে যায়। বেসরকারি মেডিকেলের মালিকপক্ষকে আমি এর চেয়েও অমানবিক হতে দেখেছি।

ডা. জাফরুল্লাহ সাহেবের গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজ থেকে যে তরুণটি ২৫ লাখ টাকা খরচ করে চিকিৎসক হয়েছে, তাকে ইন্টার্নির সময় সম্মানি দেওয়া হয় সাত হাজার টাকা। ইন্টার্নি শেষে লেকচারারদের বেতন বিশ হাজারের উপরে উঠে না।

এই রাষ্ট্রের আরও কত চিকিৎসক দরকার? কেন এই দুরবস্থা চিকিৎসকদের, কিভাবে ব্যাঙের ছাতার মতো এতো বেসরকারি (কিছু সরকারি মেডিকেলও) মেডিকেল গড়ে উঠেছে- এই প্রশ্নগুলো অনেক বিতর্ক তৈরি করবে, মন্ত্রীমশাই অনেক অনেক চোখ রাঙাবেন, লিজেন্ডারি অধ্যাপকরা সরকারি মেডিকেলে থাকা অবস্থায় বেসরকারি মেডিকেল থেকে পড়ে সরকারি মেডিকেলে অবৈতনিক ট্রেনিং করতে তরুণটির দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকাবেন, চূড়ান্ত অপমান করবেন এবং অবসর গ্রহণ করার পর একটা বেসরকারি মেডিকেলে অধ্যক্ষ হয়ে বসবেন।

এসব বড় বড় বিষয় নিয়ে আসলে আমার আপনার কিছুই করার নাই। বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে চূড়ান্তভাবে গণবিরোধীরূপে গড়ে তোলা এবং মেডিকেল ব্যবস্থাকে চূড়ান্তভাবে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার জন্য নীতিনির্ধারকদের আপাতত অভিশাপ দেই।

কিন্তু আপনি আপনার সম্ভাবনাময় সন্তানটিকে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে কেন এই অনিশ্চয়তার মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাচ্ছেন? নচিকেতা নীলাঞ্জনার দুঃখে দাম দিয়ে যন্ত্রণা কিনে। 

আপনি ত্রিশ থেকে চল্লিশ লাখ টাকা খরচ করে সন্তানের জন্য এ কোন যন্ত্রণা কিনতে চান?

 

ডা. শরীফ উদ্দিন

এমবিবিএস (সিএমসি), সিসিডি (বারডেম) ডি-অর্থো (নিটোর),
হাড়-জোড়া, বাত ও ব্যথা বিশেষজ্ঞ অর্থোপেডিক ও ট্রমা সার্জন