Thursday, August 4, 2022

বাংলাদেশের মানুষ চেন্নাই কেন যায়?

বাংলাদেশের মানুষ চেন্নাই কেন যায়?
 
চোখের সমস্যা নিয়ে টানা তিনমাস চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে দৌড়ঝাঁপ করার পর অনেকটা বাধ্য হয়ে, জীবনে প্রথমবারের মতো, চিকিৎসার উদ্দেশ্যে চেন্নাই গিয়েছিলাম সপ্তাহদুয়েক আগে। সেখানে শংকর নেত্রালয়, অ্যাপেলো হাসপাতাল এবং আরও একাধিক প্যাথলজিক্যাল সেন্টারে (প্রসঙ্গত বলা দরকার, শংকর নেত্রালয় থেকে যেখানে আমাকে মস্তিষ্কের ঝুঁকিপূর্ণ এমআরআই করতে পাঠানো হয়েছিল তা শ্যামলীর রোগী ধরা প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে কোনো অংশে কম ভয়াবহ নয়) চরকির মতো ছুটোছুটি করে প্রায় শূন্য হাতে ঢাকায় ফিরে যে-প্রশ্নটি আমাকে বেত্রাঘাত করছে তাহলো: বাংলাদেশের মানুষ চেন্নাই কেন যায়?
 
না, ঠিক বললাম না। প্রশ্নটি শুরু থেকেই আমাকে উত্যক্ত করছিল পদে পদে। আমি বহু কষ্টে তাকে দমিয়ে রেখেছিলাম। প্রথমদিন শংকর নেত্রালয়ে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে একজন চিকিৎসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য আমাকে ৭০ থেকে ৮০ জন রোগীর পেছনে কাতারবন্দি হতে হয়েছিল। একজন চিকিৎসক কীভাবে একদিনে এত বিপুল সংখ্যক জটিল রোগীকে চিকিৎসা দেবেন-- তা কিছুতেই আমার বোধগম্য হচ্ছিল না। কঠিনতম এক ধৈর্যপরীক্ষার শেষে যা পাওয়া গেল তাহলো ঝড়ো গতিতে চিকিৎসকের কিছু পরামর্শ-- যার মুখ্য অংশই হলো আরও কিছু টেস্ট। এবং সেসঙ্গে (ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হলে) বাড়তি পাওনা হিসেবে রূঢ় ব্যবহার তো আছেই।
 
দ্বিতীয় দিনের অভিজ্ঞতাও ভিন্ন নয়। 
আবারও টেস্ট। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতাল। সবচেয়ে ভয়াবহ হলো অ্যাপেলো হাসপাতালের অভিজ্ঞতা। ভারতীয় রুপিতে প্রায় দু হাজার টাকা দিয়ে সেখানে নানা চেষ্টা-তদবির করে একঘন্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার পর (অপেক্ষমান রোগীদের বসার কোনো ব্যবস্থা নেই) যে কনসালটেন্ট ভদ্রলোকের সাক্ষাৎ পেলাম তিনি টেস্ট ছাড়া কোনো কথাই শুনতে রাজি হলেন না। শুধু তাই নয়, মাত্র একমাস আগে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল থেকে করা টেস্ট রিপোর্টটি ছুঁয়ে দেখতেও রাজি হলেন না তিনি। ফলে বিপুল অর্থ ও শ্রম ব্যয় করে বলতে গেলে শূন্য হাতেই আমাকে ঢাকায় ফিরতে হয়েছে। আর যেটুকু চিকিৎসা বা পরামর্শ তারা দিয়েছেন তা আমাদের চক্ষু বিজ্ঞান কিংবা বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালের চেয়ে বিন্দুমাত্র ভিন্ন বা নতুন কিছু নয়।
 
 
ফেরার পথে বাংলাদেশের একজন পেশাদার কূটনীতিক ও চিকিৎসকের কাছ থেকে যা শুনলাম তা অবিশ্বাস্য। জানা গেল, ভারত বছরে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার আয় করে এ খাত থেকে।
 তার মধ্যে বাংলাদেশের অবদান অর্ধেকের কাছাকাছি।
 নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের প্রায় ১০ হাজার নাগরিক অবস্থান করে চেন্নাইতে--যার প্রায় পুরোটাই চিকিৎসাগত কারণে।
 টাকার অঙ্কটার সত্যাসত্য সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই। তবে আমার পর্যবেক্ষণও ভিন্ন নয়। শংকর নেত্রালয় বা অ্যাপেলো হাসপাতালে যে উপচে পড়া ভিড় দেখেছি (যা আমাকে বারবার ঢাকার পাবলিক হাসপাতালগুলোর কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছিল) তার সিংহভাগই বাংলাদেশের। এর মধ্যে জমিজমা বিক্রি করে চিকিৎসা নিচ্ছে এমন মানুষের সাক্ষাতও আমি পেয়েছি। শুনেছি গ্রেড ফোরের এক ক্যান্সার রোগীর ৫০ লক্ষ টাকা বিলের ইতিবৃত্তও।
 
 
বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে ব্যবস্থাপনা ও আচরণগত কিছু সমস্যা আছে-- একথা অসত্য নয়। কিন্তু চেন্নাইয়ে শংকর নেত্রালয়ের ক্যান্টিন থেকে শুরু করে অ্যাপেলো হাসপাতালের বিল কাউন্টার পর্যন্ত কোথায় না আমরা রূঢ় ব্যবহার কম পেয়েছি! দেখেছি সিরিয়াল ভঙ্গ করে দূরদূরান্ত থেকে আসা রোগীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখতে! দুএকটি ব্যতিক্রম ছাড়া চিকিৎসকদের আচরণও খুব একটা ভিন্ন মনে হয়নি। 
 
বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় হাসপাতাল, চিকিৎসক-নার্স ও চিকিৎসা-সরঞ্জামের ঘাটতি আছে। ফলে চিকিৎসকদের অনেক চাপের মধ্যে কাজ করতে হয়। 
তারপরও চক্ষু বিজ্ঞান ও বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালের চিকিৎসক ও নার্সদের মধ্যে আমি যে দরদি মনোভাব দেখেছি তার কোনো তুলনা হয় না।
 পোশাক শিল্পসহ অনেক ক্ষেত্রে আমরা বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়েছি। আমার মনে হয়েছে, চিকিৎসা খাতেও সেটা সম্ভব।
 বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার এ সংকটকালে যত দ্রুত সম্ভব দেশের মধ্যেই উন্নতমানের বিশেষায়িত চিকিৎসা ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। 
বিদেশিরা না আসুক, দেশের মানুষের বিদেশ যাওয়া বন্ধ করা গেলে কেবল যে হয়রানি ও দুর্ভোগের লাঘব হবে তাই নয়, সাশ্রয় হবে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাও।
 
ঢাকা: ২৯ জুলাই ২০২২