Monday, November 16, 2015

'ওরে গাধা, তোরে গাধা বানাইতে কত খরচ হইছে জানিস?'

শোনা ঘটনা এবং ঘটনাটি সত্য।

বাংলাদেশের একজন তরুণ চিকিৎসক স্বাধীনতার পর উচ্চ শিক্ষার্থে ইংল্যান্ড গেলেন, অক্সফোর্ড থেকে ডি.ফিল (পিএইচডি সমতুল্য) করে দেশে ফিরলেন। যেকোনো মেডিকেল ডিগ্রি রাষ্ট্রীয় মেডিকেল কাউন্সিলের অনুমোদন ছাড়া লেখা নিষেধ, কাজেই সেই চিকিৎসক ভদ্রলোক বিএমডিসি'র শরণাপন্ন হলেন।

বিএমডিসি'র রেজিস্ট্রার সাহেব আবেদনপত্রের দিকে তাকিয়ে নাকের লোম ছিঁড়তে ছিঁড়তে বললেন, 'হুম.. এমবিবিএস.. ঠিক আছে.. তারপর এফসিপিএস.. ঠিক আছে.. কিন্তু এইটা আবার কি? ডি.ফিল? এ কোন প্রজাতির বস্তু?'

আবেদনকারী চিকিৎসক রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, 'এটা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি'

রেজিস্ট্রার সাহেব ভাবলেশহীন গলায় বললেন,'দ্যাখো, এই ডিগ্রী তো আমাদের লিস্টে নাই। তুমি অক্সফোর্ড রে বলো আমাদের কাছে চিঠি পাঠাইতে, তোমার কপাল ভালো হইলে অনুমোদন পাইলেও পাইতে পারো।'

এই হচ্ছে আমাদের রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদের আলিশান ভাবমূর্তি।
অক্সফোর্ডও এখানে পাত্তা পায় না।

পাঠক ভাবতেই পারেন, এতো বহুকাল আগের কথা, এখন 'দিন বদলাইছে' না?

মাত্র কয়েক বছর আগের কথা।
জাপান থেকে পাবলিক হেলথে পিএইচডি করা এই ভদ্রলোক সেখানেই পোস্ট-ডক্টোরাল করলেন এবং জাপানেই শিক্ষকতা শুরু করলেন। বেশ কিছুদিন কাজ করে উনার মনে হল দেশের জন্য কিছু করা দরকার, বেতন শতভাগ কমে গেলেও পরোয়া নেই, মরলে দেশের মাটিতে মরাই ভালো। সীমাহীন আবেগের সাথে দেশে ফিরে বিজয়নগরে বিএমডিসি ভবনে গেলেন ডিগ্রি অনুমোদন নিতে। সেখানে তাকে জানানো হল, জাপানি ঐ বিশ্ববিদ্যালয় লিস্টে নাই, কাজেই ডিগ্রির কোন দাম নাই। তিনি আক্ষেপ করে বললেন, আপনারা যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অনুমোদন দেন, আমার বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকার চেয়েও ওয়ার্ল্ড র‍্যাংকিং এ অনেক উপরে। বিএমডিসি জানালো, তাদের কিচ্ছু করার নাই। তবু তারা 'বিশিষ্টজনদের' কাছে এই ডিগ্রির মূল্যায়ন সম্বন্ধে জানতে চাইবে।

ঐ বিষয়ে মাস্টার্সধারী দুই বিশেষজ্ঞ বিএমডিসি'কে জানালেন, তারা এই ডিগ্রির কোন মানে খুঁজে পাচ্ছেন না। এই বিষয় বাংলাদেশে কেন দরকার, সেটাও তাদের বোধগম্য না। নিজেদের অজ্ঞতাকে বিজ্ঞের রায় ভেবে বিএমডিসি তাকে প্রত্যাখ্যান করল।

যে প্রোগ্রামে উনি জাপানে ক্লাস নিতেন, ঢাকায় সেই প্রোগ্রামে তিনি ছাত্র হিসেবে ঢুকলেন। সকল পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে এমপিএইচ শেষ করলেন। এর মধ্যে আরেক ঘটনা ঘটল, নিজের দু:খের কথা তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মানুষটিকে জানাতে গেলেন। অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যেও সেই রাষ্ট্রনায়ক তাকে এক-দেড় মিনিট সময় দিলেন, সব শুনে সেই চিকিৎসককে একটা কথাই জিজ্ঞেস করলেন,'আপনারে দেশে আসতে কে বলছে?'

রাগে দু:খে ক্ষোভে সেই চিকিৎসক বেরিয়ে এলেন।
এর বেশ কিছুদিন পর এক রাতে তার মুখেই এই কাহিনী শুনলাম।

আজ পেলাম আরেক আনন্দের সংবাদ।
ইংল্যান্ডের এমআরসিপি নামক আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ডিগ্রিটাকে হাসতে হাসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে বাংলাদেশ। এই ডিগ্রি নিয়ে এদেশে কেউ বিশেষজ্ঞ হতে পারবে না। কি হবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে? 'সিম্পল এমবিবিএস' কিংবা বিশেষজ্ঞ হলেও তাবেদারি করতে পারবে- এমন চিকিৎসক দরকার। যে চিকিৎসক নিজের নিরাপত্তা তো দূরের কথা, অপ্রতুল ঔষধ -সরঞ্জামাদি নিয়ে রোগীর অধিকার বিষয়েও কথা বলবে না। এমন চিকিৎসক দরকার, সে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে যাবার যোগ্যতা তো রাখবেই না, বরং বারবার এসে পা চাটবে আর বলবে, 'আমায় দয়া করে জুনিয়র কনসালটেন্ট বানিয়ে দিন, আমি লাগলে ছমাসে একবার এসে পা চেটে দেব, দয়া করুন প্রভু'। এমন চিকিৎসক দরকার, যে ইউএনও কিংবা ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারকে স্যার স্যার বলে লালা ঝরাবে। এমন চিকিৎসক রাষ্ট্র চায়, যে চিকিৎসক অনাহারে অর্ধাহারে পুঁথিগত বিদ্যা আওড়াবে এবং রাষ্ট্র-সমাজ বিনির্মাণে অংশ না নিয়ে ক্ষমতাবানের দাসত্ব করবে। আদর্শিক মহামানবের পৌরাণিক স্থাপত্যের মত ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা নয়, চিকিৎসকের থাকতে হবে বারবার লজ্জা পেয়েও খাবার দিলে চেটেপুটে খাওয়ার সক্ষমতা। আইসিইউ'তে রোগীর লাইফ সাপোর্ট খুলে নেবার শেষ সিদ্ধান্ত যিনি নেন, সেই চিকিৎসক দুই দিন ভেবেও নিজের প্রতিনিধি ঠিক করতে পারেন না- এমন অথর্ব জড়বুদ্ধির প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড নির্বোধ নির্মাণ রাষ্ট্রের লক্ষ্য। সকালে বিকালে এই গাধার পাছায় লাথি দিয়ে রাষ্ট্র স্মরণ করিয়ে দিতে কসুর করবে না, 'ওরে গাধা, তোরে গাধা বানাইতে কত খরচ হইছে জানিস?' লাথি খেয়েও এ গাধাকে হাসতে হবে, এবং সবিনয়ে বলতে হবে, 'সবই প্রভুর দয়া'।

বিশ্বমানের চিকিৎসক ও শ্রেষ্ঠ নাগরিক হিসেবে জন্মানোর, বেড়ে উঠার এবং টিকে থাকার পথ আজ রুদ্ধ।
অবশ্য এই লাইনটাকে কেউ গাধার প্রলাপ হিসেবেও ধরতে পারেন।

দোষের কিছু নাই। 


collected

No comments:

Post a Comment