Wednesday, May 27, 2015

মানবসেবার দায়ভার - ডাক্তারদের একার ?

চারটা বাস্তব ঘটনা

দৃশ্যপট ১

মঞ্জু একটা ছোট চাকরি করে
মাসে মাইনে পায় তিন হাজার দুইশ টাকা।
গত মাসে অসুখ হয়েছিল খুব, এক হাজার টাকা ধার হয়ে গেল।
কিভাবে পাওনা দেবে, দিয়ে কিভাবে চলবে বাকি মাস ভাবছিল সে। হঠাত মায়ের কথা মনে পড়ে গেল।
মা বলছিল, বাবা এই মাসে বাড়িত হাজারটা টাকা পাঠাইস, ঘরে চাল নাই।
আমেনা আপার বাড়ি হইতে ভাতের মাড় নিয়ে খাই। তোর ছোটভাইটার অসুখ খুব "
মঞ্জু ভেবে পায়না তার এখন কি করা উচিত।
সারা পৃথিবীর অন্ধকারগুলো তাকে ঘিরে ধরছে ক্রমশ

দৃশ্যপট ২

ভোরবেলা দরোজায় হালকা আওয়াজ শুনে ঘুমঘুম চোখে দরজা খুললেন সুরাইয়া বেগম।
সামনে হাড় জিরজিরে চৈতার মা দাড়িয়ে আছে।
তার চোখমুখে ফুটে উঠেছে অসহায়ত্ব।
শরীরে জড়ানো এক ছেড়া শাড়ি, কোন ভাবে লজ্জা ঢেকে রেখেছেন।
কে বলবে এই চৈতার মা একসময় সুরাইয়ার সহপাঠী ছিলেন!
সুরাইয়া শহুরে ছেলের সাথে বিয়ে করে বিয়ে করে শহরে পাড়ি জমালেন, চৈতার মা থেকে গেলেন গ্রামে।
"আপা, এই ছাগল টা পাচ দশ টাকায় কিনে নেন আপা। বন্যায় ঘর ভাইসা গেছে। চারদিন ধরে সজিনাডাঁটা সিদ্ধ করে খাই। এই ছাগলের বাচ্চাডা কিনেন আপা।''
সুরাইয়া দেখেন, ছোট্ট এক ছাগলছানা, খুব বেশি হলে চার পাঁচদিন বয়স হবে হয়ত, এখনো মায়ের দুধ না খেয়ে কিভাবে বেঁচে আছে কে জানে।
ছাগল ছানার চোখে ভয়, চৈতার মার চোখে অসহায়ত্ব

দৃশ্যপট ৩

বোয়ালিয়ার জমিদারের আদরের মেয়ে আসিয়া বেগমের বিয়ে হয়েছিল একজন সাধারন চাকুরীজীবীর সাথে।
বর ধার্মিক মানুষ।
জগতে টাকা পয়সা জমিয়ে রাখার পক্ষপাতী ছিলেন না।
ভবিষ্যতে কি হবে জিজ্ঞেস করলে উনি অমায়িক হাসি দিয়ে বলতেন, সব উপরওয়ালার ইচ্ছা।
একদিন দশজন ছেলেমেয়ে আর ধারদেনা মাথায়নিয়ে উনি হুট করে মারা গেলেন ।
আসিয়া বেগমের মাথায় পাহাড় ভেঙে পড়ল।
দশ ছেলেমেয়ের ভেতর বড় দুইটা মেয়ে ছাড়া সবাই ছোট, পড়াশোনার খরচ দেওয়া দূরের কথা, এই দশটা মুখকে খাওয়াবেন কি?
বড় ছেলেটা এবার মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে, বাপের খুব শখ ছিল ডাক্তার বানাবে বড় ছেলেকে। সেই ছেলেটার কি হবে?
উনি নিজের আত্মমর্যাদা কে কবর দিয়ে ছুটলেন মায়ের বাড়ি, ততদিনে বাপ মা কেউ বেঁচে নেই।
ভাইরা জায়গা জমি নিজেদের ভেতর ভাগ করে নিয়েছে।
আসিয়া বেগম ভাইদের পা ধরলেন, মাথার ঘোমটা ফেলে সদর দরোজায় আলুথালু চুলে বসে পড়লেন এককালের অভিজাত আসিয়া বড়ভাইরা তামাশা করলেন, ভাবীরা ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলেন।
গলায় দড়ি দিতে যেয়েও দিতে পারলেন না আসিয়া, ঘরে যে দশটা ছোটছোট বাচ্চা রেখে এসেছেন!
অভুক্ত সন্তানের কথা ভেবে নিজ বাড়ির পথে হাটা ধরলেন।
পথে মানুষ হাততালি দেয়," দেখ দেখ, ভাত পায়না ব্যডাক দাক্তরী পড়াবে। জগতের কুফা। স্বামীডারে খ্যাছে, নিজের ছোলগুলাক না খিলে থুছে ডাইনী কোথাকার।"
আসিয়া নীরবে চোখের জল ফেলেন।

দৃশ্যপট ৪

রাজশাহী মেডিকেলের ১৪ নাম্বার ওয়ার্ড।
ফুটফূটে একটা ছেলে বেডে শুয়ে আছে, তার মা হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন পরম মমতায়
ছেলেটার ক্যান্সার ধরা পড়েছে।
চিকিৎসা করতে খরচ লাগবে প্রচূর।
সদ্য ওয়ার্ড করতে আসা মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, চিকিৎসা করাবেন না?
ছেলেটার মা হাসিমুখে বলে, মা, আমি গ্রামে স্কুলের মাস্টার, ছেলের বাবা আমাকে ছেড়ে সিলেটে অন্য এক মহিলাকে বিয়ে করেছেন। উনি কোন যোগাযোগ করেন না। যেই বেতন পাই, খাওয়াই জোটে না ঠিকমত, ছেলের চিকিৎসা কিভাবে করি বল মা? ঘরে আরেকটা ছোট ছেলে আছে। সোনার একটা নাকফুল ছিল। বেঁচে কিছু টাকা পাইছি। ছেলেটার জন্য ভালমন্দ কিছু কিনে দেই যতদিন বাঁচে। ছেলেটার আংগুর খুব পছন্দ মা। ''
মায়ের কন্ঠস্বর ভারী হয়ে ওঠে।
ছেলেটার শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত হতে থাকে, মা আরো জোরে জোরে বাতাস করতে থাকেন "
চারটা ঘটনা লেখলাম।
প্রথম টা একজন ফেসবুক বন্ধুর ঘটনা, দ্বিতীয় গল্প আমার নানি সুরাইয়া বেগমের,তৃতীয় গল্প আমার দাদী আসিয়া খাতুনেরর এবং চতুর্থ গল্প সরাসরি আমার চোখে দেখা বাস্তব।
বাংলাদেশের অত্যন্ত স্বাভাবিক চিত্র এই চারটা ঘটনা
এরকম হাজার হাজার ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত।
মানুষ কতটা অসহায় হতে পারে, তার উদাহরণ বাংলাদেশের।
পৃথিবীতে মানবাধিকার ক্ষুন্ন করা নিয়ে অনেক হইচই হয়, আর বাংলাদেশে মানবাধিকারের অস্তিত্বই নেই।
দেশের এই দারিদ্র্য কে যদি অসুখের সাথে তুলনা করি, আর দরিদ্র জনগন কে অসুস্থ ধরি
আর অবস্থাপন্ন জনগনকে সুস্থ
এখন, আপনিই বলুন, একজন অসুস্থ, একজন রোগীর চিকিৎসা কি রোগী নিজে করবেন, না তার চিকিৎসায় সুস্থ মানুষ কে এগিয়ে আসতে হবে?
এই অসুস্থ জনগনের চিকিৎসার দায়িত্ব কি অবস্থাপন্ন মানুষের নেওয়া কর্তব্য না??
সমাজে একজন ডাক্তারের কাছে মানুষ অনেক অসহায় অবস্থায় যায়, একজন দরিদ্র সেরকম একজন ধনীর কাছে অসহায়। সেক্ষেত্রে একজন এমবিবিএস ডাক্তার যেমন চিকিৎসক, একজন মানবতাবোধসম্পন্ন ধনীও চিকিৎসক। একজন রোগের চিকিৎসা করেন, আরেকজন দারিদ্রের।
দেশে রোগের ডাক্তার অনেক, দারিদ্রের ডাক্তার কজন??
দেশে ধনীদের সংখ্যা আন্দাজ করার জন্য রাজধানীতে রিকশার চেয়ে বেশি গাড়ি আর নান্দোসের দশ হাজার টাকা দামের মুরগীর মাংসের আইটেম ই সবচেয়ে ভাল উদাহরন।
মানবসেবার ঠিকাদারি শুধু MBBS FCPS পাশ করা কয়েকজন মানুষের না, মাইকে গলা ফাটানো কয়েকজন নেতার না , জায়নামাজে বসা মানুষগুলার না, এই দায়িত্ব সবার
ডাক্তারদের গ্রামে যাওয়া নিয়ে কটাক্ষ করে যাওয়া মানুষ,সুযোগ পেলেই মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত করে দেন,খুন করে পুকুরে পুতে ফেলেন, রেপ করেন। আমজনতা শুধু ডাক্তারের প্রতি তিলে তিলে জমা রাগ ক্ষোভ আর প্রতিহিংসার বশে ডাক্তারের নিরাপত্তার জন্য এগিয়ে আসেন না। গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকা মেডিকেল ঃ ডাক্তার মার খেলে, খুন হলে সবাই ডাক্তারের দিকে সবগুলা আঙ্গুল তাক করেন।
একবার নিজেকে আয়নার সামনে ধরে দেখেন, নিজে কতবার গ্রামে যেয়ে অসহায় দুঃস্থ মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন
ডাক্তারদের দিকে আংগুল তোলার আগে একবার ভেবে দেখেন, নিজেও একজন মানুষ হয়ে জীবনে কতটুকু করেছেন মানুষের জন্য?
মানবসেবার দায়ভার - ডাক্তারদের একার ?
----------
নিসর্গ অমি

No comments:

Post a Comment