Tuesday, June 7, 2016

এই দেশ কি সম্পূর্নরূপে প্রস্তুত?

#‎সচেতন_হতে_আর_কত_দেরী_পাঞ্জেরী‬?

--শুনলাম, তোমার আম্মার দুইটা কিডনীই নষ্ট, ডায়ালাইসিস করায়।
--জ্বি, ঠিকই শুনেছেন
--ইন্ডিয়া নিয়া যাচ্ছ না কেন? এদেশের ডাক্তাররা কি কিডনীর চিকিৎসা পারে?কত লোক ইন্ডিয়া থেকে ভালো হইয়া আসলো।
--এটার একমাত্র Definitive চিকিৎসা ডায়ালাইসিস, কিডনী ট্রান্সপ্লান্ট করা যায়, ডোনার পাচ্ছি না।
--(একটু কাছে এসে, ফিসফিস করে) আমার একজন পরিচিত আছে, কিডনীর ব্যবস্থা কইরা দিব।
--নাহ, ডোনার নিজেদের মাঝে হলে ভাল, ম্যাচিং ভালো হয়, কিডনী ট্রান্সপ্ল্যান্ট এর পর ঝামেলা হয় না।নাহলে রোগী রিস্ক এ পড়ে যায়, তাছাড়া এটা বেআইনিও।
--(আরও কাছে এসে), নাও এই নাম্বারটা রাখো, ইনিও কিডনীর ডাক্তার। ডায়ালাইসিস লাগে না, উনার নিজের আবিস্কৃত ওষুধ আছে।
--দুঃখিত, নাম্বার লাগবে না, মেডিকেল সায়েন্স এধরনের কোন ওষুধ স্বীকার করে না।
--তুমি তো খুব যন্ত্রণা করো বাবা!! শুনো তুমি কাছের লোক, আসল কথা বলতে বাধা নাই, উনার জ্বীন সাধনা আছে।
--শুনে খুশি হলাম।আমাকে একটু উঠতে হবে।

ইন্টারকমে ফোন দিয়ে বললাম, যে লোক এখন আমাদের বাসা থেকে নীচে নেমে যাচ্ছে, এই লোক যাতে আমাদের বাসায় আর না ঢুকতে পারে।আসলে বলবেন, বাসায় নাই।

এই হলো এই দেশের সাধারণ জনগণের অবস্থা।এদের আমি খুব একটা দোষ দেই না।সমস্যাটা অন্য জায়গায়। কয়দিন আগে দেখলাম ওই ডাক্তার রীতিমত একটি ফেসবুক পেইজ ওপেন করে তার উদ্ভাবিত ওষুধের প্রচারণা চালাচ্ছেন, যেখানে তিনি প্রচার করছেন যে কিডনী রোগীদের ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন নেই।মেডিকেল সায়েন্সটা কি এতটাই খেলো? এদেশের অধিকাংশ ডাক্তারের কি এই ধারণা আছে যে, কিভাবে কত Randomized Controlled Trial, কত Meta-analysis এর মধ্য দিয়ে মার্কেটে এই ঔষধগুলো আসে, তার পর আবার চলে পোষ্ট মার্কেটিং সার্ভিলেন্স।নিজের মনে হলো, আর একটি ঔষধ মার্কেটে ছেড়ে দিলাম!!!এত সহজ!!!--সত্যি সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ।আমি নিশ্চিত, কয়দিন পর এই খবরটাও ফেসবুকে ভাইরাল হবে।

কয়েকদিন ধরে আরেকটা খবর ফেসবুকে হটকেক, স্ট্রোকের রোগীকে হাতে পিন দিয়ে ফুটা করে রক্ত বের করলে রোগী বেঁচে যায়।অনলাইন শিরোনামটাও সেইরকম -" আগে জানা থাকলে আমার বাবা মারা যেত না।" অনলাইন পেপার যারা চালায়, আমার ধারণা তারা অধিকাংশই সারাক্ষণ পর্ণো দেখা অপদার্থ, মাঝে মাঝে অনলাইন সাংবাদিকতা করে, সেটাও যৌন সুড়সুড়ি দেয়া ভিডিও লিঙ্ক সহ।পাবলিক উৎসাহ নিয়ে শেয়ার করছে, "স্ট্রোক থেকে বাঁচার কৌশল"।
এদেশের লোক চিকিৎসা থেকে অপচিকিৎসায় বেশী আগ্রহী।আমি এ ব্যাপারটায় বেশী কেয়ার করি না, গা সওয়া হয়ে গেছে, প্রকৃত শিক্ষা থেকে এরা অনেক দূরে আছে। সমস্যা হলো, কিছু ডাক্তারও খবরটা প্রচার করছে, গাঁজাখুরি ব্যাখ্যা দাঁড় করাচ্ছে। মূল ক্ষতিটা শুরু হলো তখন--ডাক্তার ব্যাখ্যা দিয়েছে!! ওরে বাপ, তাহলে তে ঠিকই আছে। তার ফলশ্রুতি হলো নীচের ছবিটা। আমার চেম্বারে রোগী এসেছে, হাতের মাঝে পিন দিয়ে মাল্টিপল ফুটা করা, রোগীর ছেলে ফেসবুক থেকে জানতে পেরেছে- স্ট্রোক হলে হাতে ফুটা করতে হয়।রোগী দেখে এক্সক্লুড করলাম এটা স্ট্রোকই নয়, গাঁজাখুরি পিন থেরাপীতো আরও পরের ব্যাপার। এর দায়ভার কে নিবে? সাধারণ লোকদের কথা বাদ দিলাম, আমাদের দেশের ডাক্তাররা কি জানে, পৃথিবী এখন চলে Evidence based medicine এর উপর? শুধুমাত্র Theoretical explanation নয়, যেকোন মেডিসিন বা Procedure কে এক্সপেরিমেন্টাল জাজমেন্টেও পাশ করতে হয়।যদি জানে, তবে একজন ডাক্তার কিভাবে এইসব ভুয়া নিউজ শেয়ার করবেন?

ক্যান্সারের চিকিৎসায় মহৌষধ, ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় বিভিন্ন ছাতামাথার গুড়া আর হার্টের ব্লকের চিকিৎসায় বিভিন্ন তুকতাক পদ্ধতিতো এখন অনেক পুরানো খবর।বিফলে নাকি আবার মূল্যফেরতের বিষয়ও আছে। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, প্রতারকরা যেসব ইস্যুগুলো নিয়ে প্রচার করে, সবগুলোই খুব সেনসিটিভ -End Stage Renal Disease, Stroke, Cancer, Heart Block. এধরনের রোগীরা বা রোগীর লোকেরা বাঁচার আশায় খরকুটো পেলেও সেটা ধরতে চায়, প্রতারকরা সুযোগের ভাল সদ্ব্যবহার করে। আশংকার কথা, এই প্রতারকের লিস্টে এখন ডাক্তারও যোগ হয়েছে। দেশ কি চিকিৎসা শাস্ত্রে আদৌ আগাচ্ছে?

সত্যি কথাটা বলি, দেশ চিকিৎসা শাস্ত্রে আগাচ্ছে, বেশ কিছু ব্যতিক্রমী যথেষ্ঠ ট্যালেন্টেড চিকিৎসক আছেন , কিন্তু যথেষ্ঠ আগাছাও তৈরি হচ্ছে।এই আগাছাগুলোই ঝামেলার সৃষ্টি করছে।আগাছাগুলো একদিনে সৃষ্টি হয়নি।যেদিন থেকে, মেডিকেল সায়েন্সে রাজনীতি প্রবেশ করেছে, যেদিন থেকে রাজনৈতিক পরিচয় অযোগ্য লোকদের ভালো জায়গায় পোস্টিং এর নিয়ামকরূপে কাজ করেছে, যেদিন থেকে প্রান্তীয় এলাকার সরকারী হাসপাতালগুলোতে নজরদারী কমিয়ে কোয়ালিটি কম্প্রোমাইজ করা হয়েছে, যেদিন থেকে ব্যাঙের ছাতার মত প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর অনুমোদন দেয়া হয়েছে অথচ নজরদারী করা হয়নি, সেদিন থেকে আগাছা জন্মানো শুরু হয়েছে, এখন ডালপালা বিস্তার লাভ করছে।এসব আগাছাদের সুযোগটা তৈরী করে দিচ্ছে কিছু দৈনিক পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল তাদের বিজ্ঞাপন প্রচার করে।কিছু নামীদামী পত্রিকা আবার এককাঠি সরেস।একই পেইজে উপরে কোলকাতার জুতার শোরুমের বিজ্ঞাপন আর নীচে সেখানেই ফুলবডি চেকআপের আহ্বান। জুতা কিনুন এবং ফুলবডি চেকআপ করুন।দেশের মেডিকেল সায়েন্সের কফিনে পেরেক ঠুকতে এরা ওস্তাদ।দেশীয় পত্রিকার দায়িত্বশীলতার কি বলিহারি!!

আমার এক মামা শ্বশুরের( উনিও ডক্টর) কথা বলি।খাবার টেবিলে উনি উনার এক এক্সপেরিয়েন্স শেয়ার করলেন। উনার দুই বন্ধু- এক বন্ধু মেডিকেলে সারাজীবন রেকর্ড মার্ক নিয়ে জ্যাক থাকার না কারণে পুরোজীবনটাই ময়মনসিংহ মেডিকেলে ইউনিট হেড হিসেবে কাটিয়ে দিলেন। আরেক বন্ধু মেডিকেলের ফার্স্ট প্রফে( নাকি টার্ম?- পুরোপুরি মনে নেই) ফেল করেও ঢাকার এক সরকারী মেডিকেলের ইউনিট হেড।আমি বলি না, প্রফে ফেল করলে সে ভবিষ্যতে যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে না, তবে যে সবসময় ভালো রেজাল্ট করেছে তার যোগ্যতা নিঃসন্দেহে বেশী। নিজেকে তখন খুব বঞ্চিত মনে হচ্ছিলো। মনে হয়েছিলো, যদি ময়মনসিংহ মেডিকেলের সেই স্যার যদি আমাদের ঢাকা মেডিকেলে থাকতেন, তবে আমরা নিজেকে আরও এগিয়ে নিতে পারতাম।অত দূরে না গিয়ে, নিজের চোখে যা দেখছি সেটাও কম না। আমাদের যে ব্যাচমেট লাস্ট প্রফে প্রথম হলো, সে কোন এক অজঁপাড়াগায়ে পড়ে আছে। অথচ, আমাদের সিনিয়র ও জুনিয়র, যাদেরকে দেখলাম, আইটেম বাদ দিয়ে ক্যান্টিনে বসে সিগারেট ফুঁকে বড় বড় কথা বলত, রাজনীতির দীক্ষা দিত, জুনিয়র ব্যাচের মেয়েদের সাথে ছ্যাবলামি করত, সেইসব আগাছা আজ বহাল তবিয়তে ভালো জায়গায় আছে, এরা একসময় অধ্যাপক হবে( ব্যতিক্রম আছে ও হবে)।এরা তো স্ট্রোকের চিকিৎসায় পিন থেরাপীর এক্সপ্লেনেশন দাড়া করাবেই, ক্যান্সারের চিকিৎসায় লতাপাতা আর ঝাঁড়ফুকও চলবে, কিডনী রোগের চিকিৎসায় মহৌষধি আরকও চলবে।সময় তো চলে গেছে ঐসব টাল্টিগিরি করতে করতেই, এত ডীপ নলেজ অর্জনের সময় কই? আমি এখনও ভেবে পাই না, কিভাবে একজন ডাক্তার পিন থেরাপী প্রমোট করেন? কিভাবে So called একজন নেফ্রোলজিস্ট ইফেক্টিভ ট্রায়াল ছাড়া তার ঔষধ প্রমোট করেন? কিভাবে একজন So called কার্ডিওলজিস্ট স্টেন্টিং বা বাইপাসের পরিবর্তে তুকতাক পদ্ধতির প্রচার চালান?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি বলেছেন, আপনি অসুস্থ হলে এদেশেই আপনি চিকিৎসা নিবেন।এই দেশ কি সম্পূর্নরূপে প্রস্তুত? আপনি হয়ত তো এদের খপ্পরে পরবেন না।সাধারণ মানুষ কিন্তু প্রতিনিয়ত এদের শিকার..


সোর্স 

No comments:

Post a Comment