Wednesday, September 14, 2016

আপনার স্বপ্ন কি?

নেপথ্য

পর্ব-১
জনৈক রুগী চেম্বারে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখানোর পর ভিজিট কত জিজ্ঞেস করলে ডাক্তার বললেন ৬০০ টাকা। রুগী ডাক্তারকে ভিজিটের টাকা পকেট থেকে বের করে দিতে দিতে বললেন, "আপনাদের ডাক্তারদের ভিজিট অনেক বেশি কেন?"

ডাক্তার সাহেব রুগীকে বললেন, "আপনার এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেয়া সম্ভব নয়। আর আপনাকে ব্যখ্যা দিয়ে বুঝিয়ে বললেও আপনি হয়তো শুনবেন, কিন্তু উপলব্দি করতে পারবেন না। আচ্ছা, আপনার বয়স কত?"
-৩৫ বছর।

কি করেন?
-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি।

আপনার ছেলেমেয়ে কয়জন?
-এক ছেলে নির্ঝর আর এক মেয়ে নাঈমা।

তাদের বয়স?
-মেয়েটার পাচ বছর আর ছেলেটা তিন।

তাদের নিয়ে আপনার স্বপ্ন কি?
-মেয়েটাকে ডাক্তার বানানোর ইচ্ছা আর ছেলেটাকে ইঞ্জিনিয়ার।

তাহলেতো হয়েই গেল। দোয়া করি আপনার মেয়ে যেন অনেক বড় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হয়। যেহেতু আপনি আপনার মেয়েকে ডাক্তার বানাতে চাচ্ছেন আর তার বয়স এখন পাচ বছর, ভিজিট সংক্রান্ত এই প্রশ্নের উত্তর আপনি ৩৫/৪০ বছর পরে বেচে থাকলে পেয়ে যাবেন। এই নিন আমার ব্যক্তিগত সেলফোন নাম্বার। ততদিন যদি আমি বেচে থাকি, আর আপনি যদি আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যান তাহলে দয়া করে আমার সাথে দেখা করে জানিয়ে যাবেন।
জ্বী আচ্ছা বলে রুগী ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এল।

পর্ব ২

পাচ বছরের সেই ছোট্ট নাঈমা এখন বেশ বড় হয়েছে। এইতো কিছুদিন আগে তার এইসএসসি রিটেন এক্সাম শেষ হলো। প্রাকটিক্যাল এখনও শুরুই হয়নি। এরই মধ্যে মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য কোন কোচিং এ ভর্তি হবে তার তোরজোর শুরু হয়ে গেছে। পরীক্ষার পরে কোথায় বিশ্রাম নিবে কিংবা বেড়াতে যাবে সেসব চিন্তা বাদ। বাবা মা আত্নীয়স্বজন সকলের স্বপ্ন তাকে ডাক্তার হতে হবে। আর এই স্বপ্ন পূরনের ধারাবাহিকতায় তাকে এক এক করে অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে আসতে হয়েছে। প্রাইমারী স্কুল পরীক্ষায় সে বৃত্তিও পেয়েছে। জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষাও বৃত্তিসহ উত্তীর্ণ হয়েছে। ভালো রেজাল্ট করেছে এসএসসিতেও। আশা করছে এবারও রেজাল্ট ভালো হবে। বাবা মা বলেছে এইবারই শেষ কষ্ট। মেডিকেলে চান্স পেলে আর কষ্ট করতে হবে না। আর পিছন ফিরে তাকাতে হবে না। বাবা মা আর নিজের স্বপ্ন পূরনের লক্ষ্যে দৃঢ় থাকে নাঈমা।

এরপর প্রাকটিক্যাল এক্সাম শেষ করে, একটি কোচিং সেণ্টারে ভর্তি হয়ে দিন রাত আগের থেকেও বেশি পরিশ্রম করে অবশেষে পেয়ে যায় সেই কাংখিত সাফল্য। একটি সরকারী মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়ে যায় সে। নাঈমার পুরো পরিবারে আনন্দের বন্যা। প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সের নাঈমার বাবার চোখে তখন স্বস্তির আশ্বাস। মেয়ে তার ডাক্তার হবে। এইতো দেখতে দেখতেই পাচটি বছর কেটে যাবে।

মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে কিছুদিন নাঈমার ভালোই কাটলো। এপ্রোন পড়ার আনন্দ, নতুন নতুন বন্ধু, নতুন পরিবেশ, নতুন নতুন রঙ্গীন বই। জীবনটাকেই তার রঙ্গীন লাগছে। আরও বেশ কয়েকমাস যেতেই নাঈমা আবিষ্কার করলো তার রঙ্গীন জীবনের রংয়ে সাদাকালোর প্রোলেপ পরতে শুরু করেছে! নিয়মিত ক্লাশ, একের পর এক আইটেম, কার্ড ফাইনাল, প্রফের ধাক্কা সামলাতেই তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সে খোজ নিয়ে দেখলো তার ননমেডিকেল বন্ধুরা যখন বিকেলের সোনালী রোদে আড্ডা দিয়ে কিংবা ঘুরাঘুরি করে বেড়াচ্ছে তখন সে কিংবা তার মেডিকেলের বেশিরভাগ বন্ধুরাই লাইব্রেরীর চারদেয়ালে টিউব লাইটের আলোয় বইয়ের পাতায় ডুবে আছে। সেখানে বিকেলের সোনালী রোদ স্পর্শ করে না! নাঈমার বাবা নাঈমার এই অবস্থা কিন্তু ঠিকই দেখছিল। আর তার কাছে পাচ বছরটাকে শুধু দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতরই মনে হচ্ছিল।

কিন্তু অন্ধকারের পরতো আলোর দেখা মিলবেই। ঠিক তেমনিই অনেক অনেক কষ্টের পর নাঈমাও পেয়ে গেল মেডিকেল সাইন্সে গ্রাজুয়েট ডিগ্রী। আরেকবার হাসলো তার পঞ্চাশোর্ধ বাবা। এইবার বুঝি তার কষ্টের দিন শেষ হতে চলল। ইণ্টার্নশীপ শেষ করতে করতে মেয়ের বিয়েও দিলেন। ছেলেরও ততদিনে ইঞ্জিনীয়ারিং শেষের পথে। যদিও ছেলে মেয়েকে এই পর্যায়ে নিয়ে আসতে তাকে কি কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তা একমাত্র তিনিই জানেন।
একদিন নাইমাকে ডেকে তিনি বললেন, "মারে, ইণ্টার্নীতো শেষ করলে। এখন কি ভাবছো?

-বাবা, সামনে বিসিএস প্রীলিমিনারী পরীক্ষা। আর জানুয়ারীতে এফসিপিএস পার্ট-১ পরীক্ষা। এইসব পরীক্ষার প্রস্তুতি নিব।
আচ্ছা মা। ঠিক আছে। পড়াশুনাটা চালিয়ে যাও।

এভাবেই একটি ক্লিনিকে পার্ট টাইম চাকরী করে বিসিএস আর এফসিপিএস এর প্রস্তুতি নিতে নিতেই দিন পার করছিল নাঈমা। কিন্তু দুটোর প্রস্তুতি নিতে গিয়ে কেমন যেন গোলমেলে মনে হচ্ছিল তার কাছে। দুটো পরীক্ষার প্রস্তুতি যে দুই রকম। নাহ! এভাবে হবে না। দুটো একসাথে চালানো যাবে না। অতঃপর একটার মায়া তাকে ছাড়তে হয়। এরই মাঝে সে দেখছে তার কোন কোন বন্ধু অনারারী (বিনা বেতনে) ট্রেনিংএ ঢুকেছে কোনও কোনও হাসপাতালে। তা যেন আরেক দূরহ জীবনের অধ্যায়। বিএসএমএমইউ এর লাইব্রেরীর এক একটা দিন যেন এক একটা পূর্ণদীর্ঘ চলচিত্রের কাহিনী। যা সকাল আটটায় শুরু হয়ে ৩৫ টাকার দুপুরের খাবারের মধ্য দিয়ে রাত দশটায় শেষ হয়। নাঈমা নিশ্চিত তার অনেক আত্নীয়স্বজনও এই খাবার এক বারের বেশি দুইবার মুখে দিতে পারবে না। পরীক্ষা পড়াশুনার চাপে সামাজিক অনেক অনুষ্ঠানেও আজকাল নাঈমার যাওয়া হয়ে ওঠেনা। আত্নীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কেউ কেউ বলছে, ডাক্তার হয়ে নাঈমার ভাব বেড়ে গেছে। কেউ কেউ আবার তাকে অসামাজিকও ভাবতে শুরু করছে। গ্রাম থেকে অনেকে আসেন বেশ আশা করে। ডাক্তার দেখানোর ব্যপারে নাঈমা সাহায্য করবে বলে। ডাক্তারের সিরিয়াল দিয়ে দেয়া, ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যাওয়া, হাসপাতালে ভর্তি করানো। আরও কত কি। মাঝে মাঝে নাঈমা করে ঠিকই কিন্তু সব সময় একইভাবে করা সম্ভব হয় না। তার পড়াশুনা কিংবা পরীক্ষার চাপ অন্যরা কিভাবে বুঝবে? তারা শুধু ভুলই বুঝতে পারে।

দেখতে দেখতে নাঈমা সন্তানের মা হয়ে যায়। জীবনে আনন্দের ধারা নেমে আসে। কিন্তু সমান তাল বেড়ে চলে কষ্টের ধারাও। ধীরে ধীরে সময় বেড়ে চলে। বয়স বাড়ে নাঈমার। তবুও থেমে থাকে না জীবনে বড় ডাক্তার হবার স্বপ্ন। সদ্য অবসরে যাওয়া নাঈমার বাবাও চোখের সামনে দেখতে থাকে মেয়ের জীবনযুদ্ধ। তার আশার মাঝেও যেন মেঘ জমতে শুরু করেছে ততদিনে। সবাই যেন অধৈর্য্য হয়ে পড়ছে। নাঈমার ডাক্তারী পড়া কেন শেষ হয় না! নাঈমার ভাইও যে ততদিনে ইঞ্জিনীয়ার হয়ে চাকরী শুরু করে দিয়েছে। সবার ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটলেও শুধু নাঈমারই ধৈর্য্যের বাধে ফাটল ধরে না। সংসার, সন্তান লালন-পালন, চাকরী, পড়াশুনা সমান তালে এগিয়ে নিয়ে যায় সে। শুধু হারিয়ে যায় বিকেলের সোনালী রোদ, জীবনের ছন্দ, গান, কবিতা, একটুখানি অবসর। নিজেকে নিয়ে কিংবা নিজের জন্য একটুখানি সময় হয়ে ওঠে না আর নাঈমার। এক রোবটিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যায় সে।

এভাবেই বছরের পর বছর কেটে যায়। ভারী ভারী বইয়ের ব্যাগ বইতে যেয়ে পিঠের মাংশপেশীর ব্যথাটাও জানান দেয় মাঝে মাঝে। পয়ত্রিশোর্ধ নাঈমা একদিন নিজেকে আবিষ্কার করে একজন পোস্ট গ্রাজুয়েট ডাক্তার হিসেবে। অতঃপর চেম্বার প্রাকটিস শুরু করে নাঈমা। তার ভিজিট ১০০০ টাকা। সেই পাচ বছর থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত উঠে আসা নাঈমার প্রতিটা দিনের কালের স্বাক্ষী হয়ে থাকল পয়ষট্টিরও বেশি বয়সী তার বাবা।

পর্ব ৩ (শেষ পর্ব)

সকাল আটটা বেজে দশ। বাইরে বেশ রোদ উঠেছে। সাথে ঝিরঝিরে বাতাসও বইছে হালকা আমেজে। একটু দূরে নিম গাছে একটা কাক ডাকছে সমানে। মিরপুরের বর্ধিত পল্লবীর ২ নং রোডে খন্দকার ভিলার দোতালার বারান্দায় বসে দিনের পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছেন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডাঃ খন্দকার মোস্তফা খালেদ। দেশের নাম করা বিশিষ্ট কিডনী রোগ বিশেষজ্ঞ। বয়স আশির কাছাকাছি। এখন আর রোগী দেখেন না। ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, প্রোস্টেট গ্লান্ড বড় হওয়া ইত্যাদি রোগে ভুগছেন তিনি। তবে মাঝে মাঝে এই বয়সেও দেশ বিদেশের বিভিন্ন সেমিনারে বক্তৃতা দিয়ে থাকেন। চায়ের কাপে চুমুক দিবেন এমন সময় সেলফোনে রিং বেজে উঠলো। তিনি রিসিভ করে বললেন, হ্যালো, কে বলছেন?

-স্যার আমি সাজ্জাদুর রহমান। আপনি হয়তো আমাকে নাও চিনতে পারেন। আবার চিনতেও পারেন। স্যার, আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই। আপনি কি আমাকে একটু সময় দিবেন?

"হা হা হা। আমার সময়ের কোন অভাব নাই।" এই বলে বাসার ঠিকানা দিয়ে খন্দকার সাহেব ফোন রেখে দিলেন।
বিকেল বেলা খন্দকার সাহেবের ড্রয়িং রুমে দুই জন বৃদ্ধ মুখোমুখি বসে আছেন। বয়সের ব্যবধান পনের বছর। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছেন। কারও মুখে কোন কথা নাই অনেক সময় ধরে। অবশেষে সাজ্জাদুর রহমান নিরবতা ভাংগলেন।

স্যার, আজ থেকে অনেক বছর আগে আমি আপনার চেম্বারে গিয়েছিলাম। তখন আমার মেয়ের বয়স ছিল পাচ বছর। আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে আপনাদের ডাক্তারদের ভিজিট এত বেশি কেন? আজ আমার মেয়ে একজন প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার। কিন্তু তার এই প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠার পিছনে যে গল্প তার প্রতিটা লাইনে আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে আপনারা যা ভিজিট নেন তা হয়তো ঠিকই আছে। আমরা দূর থেকে আপনাদের শুধু ভুলই বুঝি। কিন্তু আপনাদের একজন ডাক্তার হবার পিছনে যে শ্রম, মেধা, সময় ব্যয় করেন সেই তুলনায় আপনাদের ভিজিট সত্যিই কম স্যার। এরপর সাজ্জাদুর রহমান ডাক্তার সাহেবকে সালাম দিয়ে বললেন,
স্যার আসি।

বলেই দেরী না করে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ডাঃ খন্দকার মোস্তফা খালেদ চুপচাপ খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

©Rasel sheikh.

No comments:

Post a Comment