Wednesday, September 7, 2016

জয় কেরানিতন্ত্র

বুয়েট থেকে পাস করা ইঞ্জিনিয়ার কিংবা মেডিকেল থেকে পাস করা ডাক্তারের চেয়েও আরবি কিংবা উর্দু বিষয়ে পড়ে মুখস্থ করে বিসিএস ক্যাডার হওয়া আমলার দাম যে রাষ্ট্রে বেশি সেখানে মেধাবীরা থাকবে কেন? 
একই কথা বলা যায় যে কোন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা প্রকৌশলী কিংবা কৃষি বিষয়ক লেখাপড়া করা ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে। কারিগরী পেশার এইসব ছেলেমেয়ে কেন দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে সেটা কী আমরা কখনো ভেবেছি।

তার আগে বলে নেই কোন বিশেষ বিষয়ের প্রতি আমার বিদ্বেষ বা প্রীতি নেই। আমি বলছি না উর্দু বা আরবি বাদে অর্থনীতি, ইংরেজি কিংবা অন্য কোন ভালো বিষয় থেকে পাস করা অ্যাডমিন ক্যাডার নেই। অবশ্যই আছে। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তারের চেয়ে এই দেশে তাদের মেধা কখনোই বেশি নয়। কেউ স্বীকার করুন বা নাই করুক এই দেশে এখনো স্কুলের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেমেয়েরাই বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে। এরপর বুয়েট মেডিকেলে যায়। সেই তুলনায় একটু পেছনের সারির ছেলেটা মানবিকে বা কমার্সে পড়ে। অথচ লেখাপড়ার পর দেখা যাচ্ছে এই রাষ্ট্রের প্রশাসনে ডাক্তার–ইঞ্জিনিয়ারদের চেয়ে সেই ছেলেটিরই কদর বেশি যে কী না ক্লাসের পেছনের সারিতে ছিল।

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি কলা বা সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের যে ছেলেমেয়েগুলো কাঙ্খিত বিষয়ে ভর্তি হতে পারতো না তারা প্রথম বর্ষ থেকেই বিসিএসের গাইড মুখস্থ করতে শুরু করেছে। বিশ্ববদ্যিালয়ের লেখাপড়ার প্রতি তাদের কোন মনোযোগ নেই বরং তাদের সব আগ্রহ ওই চাকুরির লেখাপড়াকে ঘিরে।

একেবারেই উল্টোচিত্র ডাক্তার, ইঞ্জনিয়ার কিংবা কৃষি বা বিজ্ঞানে পড়া ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে। হঠাৎ করে চাকুরির পরীক্ষা দিতে এসে তারা সাধারণ জ্ঞান নিয়ে হাবুডুব খেতে শুরু করে। অনেক কষ্ট করে যেই ছেলেটি বিসিএসে স্বাস্থ্য, কৃষি কিংবা প্রকৌশলী ক্যাডারে নিয়োগ পেলো কিংবা কলেজের শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিলো চাকুরি শুরুর কিছুদিন পরেই তিনি বুঝতে পারেন ক্লাসের পেছনের সারির সেই ছেলেটি আজ তার বস হয়ে গেছে। কারণ তিনি প্রশাসনের কর্মকর্তা।

সিরাজগঞ্জের একজন কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল একবার। তিনি একযুগেরও বেশি সময় ধরে কৃষি কর্মকর্তা। বহুকষ্টে মোটরসাইকেলে চড়ে আমার সঙ্গে একটা নিউজের বিষয়ে কথা বলতে স্পটে এসেছিলেন। নানা বিষয়ে তাঁর গবেষণা।ফসলের কীটপতঙ্গ নিয়ে তিনি কাজ করছেন। তার সেই কাজ দেখতে জাপান থেকে লোকজন এসেছে। তারা তাকে জাপানেও নিয়ে যেতে চায়। সেই কর্মকর্তা আফসোস করে জানালেন, চোখের সামনে কতো জুনিয়র এসে ইউএনও হয়ে ডিসি হয়ে চলে গেছে। আফসোস করে বললেন, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর দ্বিতীয়বার গিয়েছিলেন প্রশাসন ক্যাডারের চাকুরির জন্য। ভাইভা বোর্ডে ইয়াজউদ্দিন স্যার তাকে বলে, বাবা তুমি কৃষিতে পড়েছো। কৃষি ক্যাডারেই থাকো। কৃষকের জন্য কিছু করো। এরপর ভাইভা না নিয়েই তাকে পাঠিয়ে দেন। এখন তাঁর মাঝে মাঝেই সরকারি চাকুরি নিয়ে আফসোস লাগে।

অনেক ডাক্তারকে বলতে শুনেছি, আমাদের আমলাতন্ত্রে ৭ম বিসিএসের একজন সিভিলসার্জনকে তার সন্তানের বয়সী সাধারন বিষয়ে পাস করে আসা ৩৩ বিসিএসের একজন ম্যাজিস্ট্রেট যখন 'সিএস সাহেব' বলে সম্মোধন করেন তখন তার প্রচণ্ড মন খারাপ হয়। আবার পরীক্ষার হলে সরকারী কলেজের সিনিয়র এসিস্ট্যান্ট প্রফেসরকেও প্রশাসন ক্যাডারে সদ্য নাম লেখানো ম্যাজিস্ট্রেট 'অমুক সাহেব' বলে সম্মোধন' করবেন এটাই যেন খুব স্বাভাবিক।

আমার কথায় আমলাতন্ত্রের শীর্ষ পদের অনেকেই মন খারাপ করতে পারেন তবুও বলছি আমাদের দেশের রাজনীতি তো নষ্ট। আমরা অনেক কিছুর জন্যই তাই রাজনীতিবিদদের দায়ী করি। কিন্তু নোংরা রাজনীতির পাশাপাশি বাংলাদেশের অনিয়ম দুর্নীতি আর পিছিয়ে থাকার একটা বড় কারন এই কেরানিতন্ত্র যাকে আপনারা বলেন আমলাতন্ত্র। জঘন্য মুখস্থ বিদ্যার বিসিএস আর কোটাতন্ত্র এই আমলাতন্ত্রের আরো ১২ টা বাজিয়েছে। বিসিএস দিয়ে মেধা তালিকার ৫০০ এর মধ্যে থেকেও চাকুরি পাবে না আবার কোটার কারণে দুই হাজারতম হয়েও চাকুরির ব্যাবস্থা আমাদের পুরো আমলাতন্ত্রের মান নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। অন্তত আমার কাছে।

আমি বলছি না প্রশাসনে সৎ লোক নেই, অবশ্যই আছে, কিন্ত আমার কাছে মনে হয় আমাদের টোটাল আমলাতন্ত্রটাই মানুষকে কষ্ট দেয়ার তন্ত্র। ব্রিটিশরা কেরানি বানানোর জন্য যে সিস্টেম এখানে চালু করেছিল আজো সেটি বহাল তবিয়তে টিকে আছে। সচিবদের কথা বাদ দিলাম এই দেশে অনেক সরকারি অফিসের নিম্নপদের কেরানিরও তাই লাখ–কোটি টাকা আছে। কারণ ওই কেরানিতন্ত্র।

উল্টোদিকে অনেক প্রকোশলী বা ডাক্তার একটু ভালো থাকতে দেশ ছেড়ে চলে যায় বিদেশে। আমি বলছি না অসৎ ডাক্তার বা প্রকৌশলী নেই। কিন্তু তাদের একটা বড় অংশই লেখাপড়া শেষে বুঝতে পারে বাংলাদেশের চাকুরির বাজারটা তাদের জন্য নয়। তাই যারা পারে দেশ ছাড়ে। আর গনিত কিংবা পদার্থবিজ্ঞান পড়া ছেলেটা কিছু করতে না পেরে কেরানি কিংবা ব্যাংকের টাকা গোনার চাকুরির জন্য লড়াইয়ে নামে।

আমাদের আমলাতন্ত্রে প্রশাসন ক্যাডারের কাছে ক্ষমতাই সব। আমাদের এই আমলাতন্ত্র এতোটাই শক্তিশালী যে আরবি থেকে পাস করেও কোন কর্মকর্তা এখানে কৃষি কিংবা স্বাস্থ্য সচিব বনে যান। আমি কোনভাবেই বুঝি না কৃষি ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা কেন কৃষি সচিব হবেন না? কেন স্বাস্থ্য ক্যাডারের বদলে ইংরেজি পড়া ছেলেটিকেই স্বাস্থ্যসসচিব হতে হবে। কেন একজন শিক্ষক শিক্ষাসচিব হবেন না?

অনেকেই বলতে পারেন কোন সাবজেক্টে পড়েছে সরকারি চাকুরিতে সেটা বিষয় নয়। চাকুরি করতে করতে তিনি আসলে যোগ্য হয়ে যান। হতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এতো বিষয়ের এতো সীট না রেখে উচ্চমাধ্যমিক পাস করিয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিলেই হয়। কারণ সেই তো অনার্স–মাষ্টার্স পাস করে একটা চাকুরি পাবার জন্য আমাদের ছেলেমেয়েদের কী ভয়ঙ্কর একটা লড়াইয়ে নামতে হয়।

যারা আমাদের এই কেরানিতন্ত্রের পক্ষে যুক্তি দেবেন তারা একটু বলেন তো আমাদের সরকারি অফিসগুলোর মান কী কমছে না বাড়ছে? সাধারণ জনগন ভূমি অফিসকে কী মনে করে? আমি তো মনে করি বাংলাদেশের আজকের অগ্রগতির পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান কৃষকের, কৃষি কর্মকর্তার। এরপর ব্যাবসায়ী, গার্মেন্টস শ্রমিক, স্বল্পশিক্ষিত প্রবাসী আর বিশাল বেসরকারি খাত। আমাদের আমলাতন্ত্রের ভূমিকা সেখানে কী খুব বেশি?

খুব অবাক হই আমাদের আমলারা যখন অবসরে গিয়ে টেলিভিশন বা পত্রিকায় সংস্কারের কথা বলেন। আচ্ছা চাকুরি জীবনে কী এসব বুদ্ধি আপনাদের মাথায় আসে না? অবশ্য ৯০ এর পরে আমাদের আমলাতন্ত্র এখন এতোটাই বিভক্ত যে সিদ্ধান্ত নিতে হয় দলচিনে। এখানে কর্মকর্তাদের মানের চেয়ে দলীয় যোগ্যতাই বেশি দেখা হয়। কাজেই তারা কতোটা ভূমিকা রাখতে পারেন সেটাও প্রশ্ন।

কেউ কেউ ভাবতে পারেন হঠাৎ করে কেন এতো কথা বলছি। সরকারি চাকুরি করা এক প্রকোশলী নতুন বেতনকাঠামো নিয়ে হতাশ হয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে। সেটা দেখেই কথাগুলো মনে এলো। বেতন কাঠামো নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক খুব ভালো উদাহরণ দিয়েছেন। তার মতে মাত্রাতিরিক্ত বেতন বাড়িয়ে এতো বেশি অপমান কেউ করেনি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের কথা না হয় বাদ দিলাম তারা অনেক সুবিধা পান। কিন্তু এই দেশে যারা সত্যিকারের মানুষ গড়ার কারিগর সেই স্কুল শিক্ষকেরা কিন্তু সরকারি অফিসের অনেক পিয়নের চেয়ে কম বেতন পান। কাজেই ডাক্তার-ইঞ্জনিয়ার-শিক্ষক সব বাদ দিয়ে দেশের তরুণরা সবাই একদিন কেরানি হতে চাইবে এই দেশে সেটাই স্বাভাবিক।

অনেকে অনেক কিছু বলতে পারেন। তর্ক বিতর্ক করতে পারেন। তবে আমি কাউকে অসম্মান করছি না। কাউকে কষ্ট দিতে চাচ্ছি না। বরং বিষয়টা নিয়ে আলোচনা হোক। কারণ এই দেশের ডাক্তার–ইঞ্জিনিয়ার–আমলা সবাই আমাদেরই ভাইবোন। তবে আমি কিন্তু দেখতে পাচ্ছি এই দেশের তরুণদের একটা বড় অংশই তাদের মেধা–যোগ্যতা শেষ করে ফেলছে একটা সরকারি চাকুরির পেছনে। ডাক্তার-ইঞ্জনিয়ার-শিক্ষক সব বাদ দিয়ে দেশের তরুণরা সবাই কেরানি হওয়ার স্বপ্ন দেখবে। আর মেধাবিদের আরেকটা বড় অংশ দেশ ছেড়ে যাচ্ছে বিশেষ করে বিজ্ঞাপনে পড়া। আর যারা থাকছে তারা বিসিএস প্রকৌশলী, কৃষি বা স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা হয়ে আজীবন ছোট হয়ে থাকছে। বড়ই আজব বাংলাদেশের শিক্ষাব্যাবস্থা আর কেরানি বানানের কৌশল। এখানে সবার স্বপ্ন এখন কেরানি হওয়া। কাজেই বলতেই হয় জয় কেরানিতন্ত্র।

>>কালেক্টেড পোস্ট<<

No comments:

Post a Comment