Wednesday, September 28, 2016

আমাদের ভারতপ্রীতি ও হে বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন


প্লট-১(#পিঁপড়ার_দল)

ওয়াইফ MRCPCH(UK) পরীক্ষা দিবে, এক্সাম সেন্টার হয় কোলকাতা অথবা মুম্বাই বা চেন্নাই।ভিসা সংক্রান্ত কাজ কমপ্লিট করার জন্য মতিঝিলের #State_Bank_of_India তে গেলাম।সিরিয়ালে আটকা পড়লাম, আমার আগে আরও প্রায় ১৫ জন লোক।সিরিয়ালে আমার সামনে থাকা লোকের সাথে টুকটাক কথা বলে সময় পার করছি ।

কথায় কথায় জানলাম উনিও উনার ওয়াইফকে নিয়ে ইন্ডিয়া যাচ্ছেন, ওয়াইফ Ankylosing Spondylitis( এক ধরণের বাতব্যাথা রোগ) এ আক্রান্ত।আমি একটু আমতা আমতা করে বললাম,'ইন্ডিয়া যাচ্ছেন কেন? যতদূর জানি এর চিকিৎসা তো এদেশেই হয়, আমার মামাতো ভাইতো এদেশেই চিকিৎসা নিচ্ছে'।

উনি বলে উঠলেন, "দূর, দূর, আর বইলেন না, এদেশের ডাক্তাররা কিছু জানে নাকি! সব মূর্খের দল।দেখেন না, আমার সামনের জন সেও চিকিৎসার জন্য ইন্ডিয়া যাইতেছে"।তার সামনের ভদ্রলোক মাথা নেড়ে এই কথায় সায় দিলেন, যতটুকু বুঝলাম Hepatitis B virus carrier, এর পারফেক্ট চিকিৎসা এদেশেই আছে, তারপরও যাচ্ছেন।এবার সে লোকের কথায় জানলাম তার সামনের লোকও চিকিৎসার জন্য ইন্ডিয়া যাচ্ছে, আমি ভিমরী খেলাম।

আমি মোটামুটি নিশ্চিত হলাম, আমার সামনের ১৫ জনের মধ্যে মিনিমাম অর্ধেক চিকিৎসার জন্য ইন্ডিয়া যাচ্ছেন।আমি এদের সাথে আংশিক কথাবার্তায় এটাও নিশ্চিত হলাম এদের অধিকাংশের চিকিৎসা এদেশেই সম্ভব ছিলো।

আমার সামনের জন আমি কেন ইন্ডিয়া যাচ্ছি তা জানতে চাইলেন।এই দেশের ডাক্তারদের যে লোক একটানে মূর্খ বলে রায় দেয়, তার কাছে কিভাবে বলি যে চিকিৎসা বিদ্যার উচ্চশিক্ষার জন্যই আমার এই মুভমেন্ট।মূল ঘটনা চাপা দিয়ে বললাম, 'ঘুরতে যাচ্ছি'।এবার ভদ্রলোকের চোখ চকচক করে উঠলো, বললো, "যান, যান, ঘুইরা আসেন, আহাহা! কি সুন্দর দেশ ! কয়েকবার গেছি।কোন কোন জায়গায় ঘুরবেন, সেইটা একটু বলি......"


প্লট-২(#ঝড়ে_বক_মরে)

আম্মু ESRD (#Irreversible, দীর্ঘমেয়াদী কিডনী জটিলতার শেষ পর্যায়) এর পেশেন্ট।আমার আত্মীয় সজনের বধ্যমূল ধারণা আম্মুকে ইন্ডিয়া নিয়ে গেলে উনি সুস্থ হয়ে যাবেন, আমি অবহেলা করে নিচ্ছিনা।একজন তো মা'র সামনেই বলে ফেললেন, "ছেলেটা আপনেরে ইন্ডিয়া নিলে বাঁইচা যাইতেন।সঠিক শিক্ষা দেন নাই, তাই বাপ-মায়ের দিকে নজর কম"।

বার বার বললে অসত্য তথ্যও সত্যের মত শোনায়। বাইরের লোকদের কথায় একসময় আম্মু মোটিভেটেড হলেন, বললেন, 'ইসহাক সাহেবেরও তো #ক্রিয়েটিনিন(এক ধরণের কিডনী ফাংশন মার্কার) ১২ ছিলো, ইন্ডিয়া গিয়ে ভালো হইছে।আমারে একটু ইন্ডিয়া নিয়ে দেখবি?' আমি বিরক্ত হলাম, বললাম, 'বাইরের লোকের কথা বিশ্বাস কর, আর আমার উপর বিশ্বাস নাই? ঠিক আছে, ইসহাক সাহেবকে কাগজপত্র নিয়া আসতে বল, দেখি ইন্ডিয়া কি ম্যাজিক দেখাইছে'।

ইসহাক সাহেবের কাগজপত্র আসলো।যা ভেবেছিলাম তাই--উনার ডায়াগনোসিস ছিল AKI( এক ধরণের #Reversible কিডনী ইনজুরী), Proper চিকিৎসা পেলে উনি এদেশেও ভালো হতেন।Reversible এই রোগের নামকাওয়াস্তে চিকিৎসা দিয়ে ইন্ডিয়ান ডাক্তরারা পার্টটা ভালোই নিয়েছে, --'কেউ পারতো না, যা ব্যাটা, তোরে ভালো কইরা দিলাম'।--"ঝড়ে বক মরে, হুজুরের কেরামতি বাড়ে"--কথাটা জানতাম, ঐদিন নিজ চোখে ইন্ডিয়ার হুজুরদের কেরামতি দেখলাম।


প্লট-৩(#বাটপারী_ওভারলোডেড)

আমি যে জায়গায় পেশেন্ট দেখি সে জায়গাটা হিন্দু অধ্যুষিত, কিছু হলেই এখানকার রোগীদের একটা বড় অংশ ইন্ডিয়া ছোটে।

চেম্বারে রোগী দেখছিলাম।রোগী ঠিকমত হাটতে পারে না।ইন্ডিয়াতে গিয়েছিলো, কাগজপত্র দেখলাম। মিনিমাম ৫০ টা পরীক্ষা, আই রিপিট, মিনিমাম ৫০ টা ইনভেস্টিগেশন করানো, Serum Trypsin লেভেলও করা।রোগী হাটতে না পারার সাথে Serum Trypsin লেভেলের ইহকালে বা পরকালে কোন সম্পর্ক আছে বা থাকতে পারে বলে আমার জানা নেই।
ক্লিনিক্যাল এক্সামিনেশন শেষে প্রেসক্রিপশনে ডায়াগনোসিস #CIDP( এক ধরণের নার্ভের রোগ) লিখে রোগীকে পরবর্তী চিকিৎসার জন্য আগারগাঁ Neuroscience Institute এ রেফার করলাম।

এতক্ষণ পরে চোখে পরলো, রোগীর স্ত্রী যক্ষের ধনের মত কি একটা যেন হাতের মধ্যে আগলে রেখেছেন।এক্সপ্লোর করে দেখি রোগীকে প্রেসক্রাইব করা ইন্ডিয়ান মাল্টিভিটামিন।৫০ পরীক্ষা শেষে মাল্টিভিটামিন!!! বাটপারির একটা সীমা থাকা উচিত--ভারতীয় মুভির একটা ডায়ালগ মনে পড়ে গেল--"ইন্ডিয়া, তুসি গ্রেট হো!"


প্লট-৪(#ইন্ডিয়ান_রামধরা)
 
এবারের কাহিনী কিংবদন্তী এক নিউরোলজিস্ট স্যারের,ঘটনাটা অনেক ডাক্তারই জানেন।এক আমলা নিউরোলজিস্ট স্যারের কাছে রোগী হিসেবে এলে স্যার ক্লিনিক্যালি ডায়াগনোসিস করলেন #GBS( এক ধরণের নার্ভের সমস্যা)।
আমলা সাহেবের তাতে মন ভরলো না।আমলা সাহেব ইন্ডিয়াতে গিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করবার পর তাকে জানানো হলো তার রোগ-GBS...." নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস,ওপারেতে সর্ব সুখ আমার বিশ্বাস"...আমলা সাহেব ওপারের সুখের স্বাদ নিতে গিয়ে রামধরা খেলেন.....


#Bangladesh_vs_India
 
(হায়রে কপাল মন্দ, চোখ থাকিতে অন্ধ)
World Health Organization(WHO) ২০১৬ সালে Health Sector এর সামগ্রিক দিক বিবেচনা করে যে ১৯০ টি দেশের World Ranking প্রকাশ করে সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৮ তম।ইন্ডিয়ার পজিশনটা জানা আছে?--১১২ তম(Screenshot কমেন্টে)।WHO এর কর্তাব্যক্তিরা ঘাস খেয়ে এই Ranking তৈরি করে নাই। এই Ranking দেখার পরও ইন্ডিয়াতে গণহারে যারা চিকিৎসার জন্য যান, তাদেরকে দেখে একটা কথাই আমার মাথায় ঘোরে-'#হায়রে_কপাল_মন্দ, #চোখ_থাকিতে_অন্ধ....'

ভারতের #নোবেল_বিজয়ী অর্থনীতিবিদ #অমর্ত্য_সেনের কথাগুলো হুবহু তুলে ধরি, “ভারত অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে থাকলেও তারা স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সংক্রান্ত সূচকে বাংলাদেশের তুলনায় অত্যন্ত পিছিয়ে।........ভারত স্বাস্থ্য সমস্যাকে জটিল করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এটি হয়নি। বাংলাদেশ গত এক দশকে এই খাতে ভাল উন্নতি করেছে।....... ভারতের মাথাপিছু জিডিপি বাংলাদেশের দ্বিগুণ, কিন্তু বাংলাদেশের গড় আয়ু ভারতের চেয়ে বেশি।”

যে কথা ভারতের সজ্জন ব্যক্তিরা স্বীকার করেন, জানেন ও বোঝেন, জাতিগতভাবে বেশী বুঝদার বাঙালীর সেটা বুঝতে সমস্যা হয়।যে দেশে এখনও millions of people- Open air defecation( সোজা বাংলায় -খোলা ময়দানে মলমূত্রত্যাগ) করে, আমাদের দেশের একশ্রেণীর লোক সেদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে আনন্দিত হয়, তৃপ্তির ঢেকুর তোলে।ভালোই.....

যে দেশের অবস্থান WHO ranking এ ইন্ডিয়ার আগে, যে দেশের বিশেষজ্ঞরা খোদ ভারতে গিয়ে ভারতকে দ্বিতীয় বানিয়ে নিজেরা প্রতিযোগীতায় প্রথম হয়(APLAR আয়োজিত প্রতিযোগিতায়), যে দেশে Kidney transplant এ নবদিগন্ত রচিত হচ্ছে, যে দেশের চিকিৎসকরা Tree man syndrome( Epidermodysplasia verruciformis) নামক rarest রোগের চোখধাঁধানো অপারেশনের নেতৃত্ব দেয়, যে দেশের চিকিৎসকরা মাতৃগর্ভে গুলি খাওয়া শিশুকে তাদের প্রজ্ঞা ও ধী-শক্তির সহায়তায় আবার তার মায়ের কোলে ফিরে যাওয়াকে নিশ্চিত করে--সে দেশ থেকে চিকিৎসার জন্য পিপীলিকার মত লোক ইন্ডিয়াতে কেন যায়?


#কারণগুলো_কিন্তু_পরিষ্কারঃ


১. #কাউন্সেলিং_এর_অভাবঃ আমি জানি, এদেশের চিকিৎসকরা রোগ ধরতে যথেষ্ঠ পারদর্শী, কিন্তু ৫ মিনিট রোগীর সাথে রোগ নিয়ে কথা বলতে তাদের বাঁধে।এ সুযোগটাই ইন্ডিয়া নেয়।ওপার বাংলায় যাওয়া মাত্রই "ওপার থেকে দাদা এসেছেন" বলে হাত ধরে তারা যখন আমাদের দেশের রোগীকে হাসপাতালে ঢোকান, তখন এই বাঙালির নরম হৃদয় আবেগে আপ্লুত হয়। ভুলেও এই বাঙালি বুঝতে পারে না যে "দাদা, দাদা" বলে ওনারা অলরেডী গাছের গোড়া কাটা শুরু করেছেন....

২.#পেইড_মিডিয়াঃ এটাও কি বলে দিতে হবে যে কোন্ কোন্ মিডিয়া এই পেইড দলের অন্তর্ভুক্ত? যদি ধরতে না পারেন তবে epic fantasy novel series-- "A Song of Ice and Fire" এর একটি ডায়ালগ মনে করিয়ে দেই- "You know nothing, Jon Snow".....

৩.#পেইড_এজেন্টঃ ইন্ডিয়ায় পোষ্ট গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হয় ৩ বছরে, যেখানে আমাদের দেশে লাগে ৫ বছর।৩ বছরে তৈরি হওয়া এই দুর্বল বিশেষজ্ঞের কিছু অংশ নিজ দেশে ভাত না পেয়ে আমাদের দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দুর্বলতায় এদেশে আসন গাড়ে।হাজার হাজার টাকা ভিজিট নিয়ে একসময় বলে পরবর্তী চিকিৎসা হবে ইন্ডিয়ায়, ইন্ডিয়ার ভিজিটিং কার্ডটাও ধরিয়ে দেয়।কি বিশ্বাস হয় না? লিঙ্ক লাগলে বলবেন, খবরটা ধরিয়ে দেব।

একটা কথা না বললেই নয়--এই পেইড মিডিয়া ও পেইড এজেন্টের জন্যই আজ বাংলাদেশে Kidney Transplant বন্ধ হবার দশা, কিছু চিকিৎসকদের অনৈতিকতাও দায়ী।ইন্ডিয়াতে গেলে এই অপারেশনের খরচ পড়ে ১৫-২০ লাখ টাকা, এর ঝুটা একটা অংশ এই পেইড মিডিয়া ও এজেন্ট পায়।বাংলাদেশে এই অপারেশন শুরু হবার পর "ঝুটা" বন্ধ হবার উপক্রম হলো, কাজেই প্ল্যান করে Kidney Transplant বন্ধ করা হলো।বাংলাদেশে এই অপারেশনের খরচ পড়তো ২ লাখ টাকা।নিজ দেশের হাজার হাজার লোকের জীবন তো বাঁচতোই, কম খরচের জন্য এসব দক্ষ চিকিৎসকদের কাছে দেশের বাইরে থেকেও রোগী আসারও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিলো।এদেশের টাকা এদেশে থাকার সাথে সাথে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এ খাতটি এখন ধংসপ্রায়।


৪.#সংশ্লিষ্ট_কর্তৃপক্ষের_আশ্চর্যজনক_নীরবতাঃ পেইড মিডিয়া ও পেইড এজেন্টের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সন্দেহজনকভাবে নীরব। নীরবতার কারণটা কি?


৫.সাধারণ জনগণের #তুলনামূলক_তথ্যর_অভাবঃ তুলনামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভালো নাকি ইন্ডিয়া ভালো -সে তথ্য সাধারণ জনগণের অজানা।এ ব্যাপারে তারা নির্ভর করে আরেক সাধারণ লোকের মনগড়া তথ্যকে।চায়ের দোকানদারও চা-বানাতে বানাতে বলে," ইন্ডিয়ার চিকিৎসার উপ্রে কিছু নাই"....আমরা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলি, "কথাডা মিছা না, কথা সত্য"।

৬.#আমি_তো_এমনি_এমনি_যাইঃ হরলিক্সের একটা বিজ্ঞাপনে এক বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো সে কেন হরলিক্স খায়? উত্তরটি ছিলো--" আমি তো এমনি এমনি খাই"....ঠিক তেমনি কিছু লোককে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, 'চিকিৎসার জন্য ইন্ডিয়া কেন যান?' উত্তর -"আমি তো এমনি এমনি যাই, ভালো লাগে"।এ গর্দভকুলের সংখ্যা কম নয়।


#পরিশেষ

"হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;—
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি, পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ...... "
স্পেসিফিক কিছু ডিজিজের সমাধানে ইন্ডিয়া এই দেশ থেকে বেটার হতে পারে, এ কথা অস্বীকার করি না।কিন্তু তা বলে ঢালাও ভাবে এদেশ থেকে চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়া যুক্তিহীন। এ ধরণের উদ্ভট কর্মকান্ড নিজের দেশপ্রেমকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, নিজের মূর্খতাকে উন্মোচিত করে। আমি জানি বাংলাদেশ এখনও চিকিৎসা শাস্ত্রে কাঙ্খিত অর্জন থেকে দূরে আছে।কিন্তু ইন্ডিয়া তার বিকল্প নয়।এই বঙ্গ-ভান্ডারে অনেক চিকিৎসক রত্ন রয়েছেন।তাদের উপর আস্থা রাখুন, তাদের সেবা নিন।দেশের কারেন্সি দেশেই রাখুন, দেশকে সমৃদ্ধ করুন.....


কার্টেসি- ডা: জামান অ্যালেক্স

No comments:

Post a Comment