Saturday, December 3, 2016

অবৈতনিক চিকিৎসক – একটি বর্বর শোষণ প্রক্রিয়ার নাম।

হেডলাইন দেখে অনেকেই অনেক বুঝেছেন আবার অনেকেই কিছু বোঝেন নাই।
 বিশেষত যারা নাকি চিকিৎসক তারা ধরতে পেরেছেন। আর অন্যরা হয়তো ভাবছেন “অবৈতনিক চিকিৎসক”? এইটা আবার কি? আগে তো শুনি নাই!!! আসুন একটু শুনি, একটু দেখি আর একটু জানি।

 অবৈতনিক চিকিৎসক কাকে বলে? নামের মাঝেই কাজের পরিচয় পাওয়া যায়।
 অর্থাৎ এরা হচ্ছে সেই সব চিকিৎসক যারা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন কিন্তু তার বিনিময়ে একটি পয়সাও পান না। বরং নিজের টাকা দিয়ে যাতায়াত আর হাসপাতালে খাওয়ার খরচ চালাতে হয়।
 মজা লন নাকি ভাই, রূপকথার গল্প শোনান? জ্বি হ্যাঁ, রূপকথার গল্প শোনাই। দেশের নাম বাংলাদেশ।
 তবে ঘটনা সত্য। এখন সারা বাংলাদেশে বিভিন্ন মেডিকেলে প্রায় পাঁচ হাজার এমন বিনা বেতনের চিকিৎসক আছেন। সংখ্যাটা আরও বেশি হতে পারে। তবে কম নয়।

 ডাক্তাররা করে ক্যান? মাথায় কি ছিট আছে নি? জ্বি না। মাথায় ছিট নাই। করার অন্যতম একটা কারন হচ্ছে-- এফসিপিএস পরীক্ষা এবং এমডি,এম এস,এম ফিল (মেডিকেলের বিভিন্ন পোশটগ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রির নাম এ গুলো) এই সব পরীক্ষার ফাইনালে অংশগ্রহন করার জন্য যোগ্যতা হিসেবে প্রশিক্ষনের জন্য তাদের বিনা বেতনে কাজ করতে হয়।


 ঠিকই তো আছে, ডিগ্রির জন্য বিনা বেতনে কাজ করে— না ভাই, ঠিক নাই। কারন পৃথিবীর আর কোন দেশে বিনা বেতনে প্রশিক্ষনের সিস্টেম নাই। (তথ্যটা যাচাই করতে পারেন) কিন্তু তাদের দেশেও পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি আছে এবং তার মান ও ভাল।

  ডাক্তাররা তো কাজ শিখে অভিজ্ঞতার ঝুলি ভারী করছেন— জ্বি করছেন। এবং পৃথিবীর সব দেশের চিকিৎসকরাই কাজ করেই অভিজ্ঞতার ঝুলি ভারী করেন। কিন্তু বিনা বেতনে কোথাও নয়।

ডাক্তারদের অভিজ্ঞতা বাড়ানোই এ সিস্টেমের লক্ষ্য— জ্বি না, ডাক্তার অভিজ্ঞতার উপর “মূত্র বিসর্জন” করার সময় কার ও নাই। সরকারি হাসপাতাল চালাতে হবে। কিন্তু চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হবে না। অতএব পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের কালা নিয়মে ফেলে চিকিৎসকদের বাধ্য করা।

 আচ্ছা এরা কি সিম্পলি “ প্রশিক্ষনার্থী” চিকিৎসক? অনেকেই ধারনা করতে পারেন, এই সব ডাক্তাররা কিছু পারে না। এদের শিখিয়ে পড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভুল, সবই ভুল। এরা যদি কিছুই না পারতো তাহলে শুধু এদের উপর নির্ভর করে প্রফেসররা রাতে বাসায় গিয়ে ঘুমাতে পারতেন না। হাজার হাজার রোগী মারা যেত। এরাই রোগীকে জরুরি চিকিৎসা দেন। প্রাথমিক ঝুকিমুক্ত করেন। প্রয়োজনে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এরা জরূরী অপারেশন ও করেন। কাজেই সরকার মূলত শেখানোর নামে চিকিৎসকের দক্ষতাকে ব্যাবহার করছে বিনা পারিশ্রমিকে।

 আচ্ছা অন্য প্রফেশনের দিকে একটু তাকাই— বাংলাদেশে অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ আছে। সেখানেও বিভিন্ন বিষয় এর উপর ছাত্র ছাত্রীরা গ্র্যাজুয়েট হয়ে বের হয়। 
তাদের জন্য কি এমন কোন সিস্টেম আছে? যেখানে তাদের বিনা বেতনে কাজ করতে হয়? না, উত্তর টা হচ্ছে না। তাহলে চিকিৎসকরা কি অমানবিক বৈষম্যের শিকার নন?

 এভাবে কি ভাল চিকিৎসক তৈরি হওয়া সম্ভব? ভাল চিকিৎসক তৈরি হবার অন্যতম প্রধান পূর্বশর্ত হল ভালভাবে পড়াশোনা করা। একটা দিনকে আমরা তিন ভাগে বা রোস্টারে ভাগ করি- সকাল,বিকাল ও রাত। তাহলে সপ্তাহে রোস্টার মোট একুশ টা। এখন বিনা বেতনের ডিউটিতে মোটামুটি ছয়টা রোস্টার করতে হয়। বাকি থাকল ১৫ টা। যেহেতু এই বিনা বেতনের চিকিৎসক “সুপারম্যান” নন। তাকেও খেতে হয়, পরতে হয় এবং সংসার চালাতে হয়। অতএব অর্থ উপার্জনের জন্য তাকে বাইরে ডিউটি করতে হয়। বর্তমানে ঢাকা শহরে প্রতি রোষ্টার কম বেশি ছয়শ টাকা। সপ্তাহে ছয়টা রোস্টার করলে তিনি মাসে পনের হাজার টাকার কাছাকাছি উপার্জন করতে পারবেন। তাহলে তার আর রোস্টার বাকি থাকে ৯ টা।

 এখন প্রশ্ন নাম্বার এক – এই চিকিৎসক সপ্তাহে সাত টা রাত ঘুমার জন্য সময় পাবেন কি? প্রশ্ন নাম্বার দুই- তাহলে এই চিকিৎসক পড়াশোনা করবেন কখন? প্রশ্ন নাম্বার তিন- এই চিকিৎসক তার পরিবারকে সময় দেবেন কখন? আর পনের হাজার টাকায় ঢাকা শহরে পরিবার সহ তার বাজেট ও আশা করি তৈরি করে দেবেন। যেখানে আপনাকে প্রতি ছয়মাসে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন পরীক্ষা দেবার জন্য প্রায় ১২ হাজার টাকা যোগ করতে হবে। মেডিকেলের দামি বই কেনার টাকা হিসাব করতে হবে। বিনা বেতনের ডিউটিতে যাবার এবং খাবার খরচ হিসাব করতে হবে।

 সবশেষে বলি- অবাক করার বিষয় এই প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। পত্রিকার পাতায় এ বোবা কান্নার খবর আসে না। পাস না করানোর হুমকিতে চিকিৎসকরাও বলতে দ্বিধাবোধ করেন। আমাদের মত এই সব অসহায় বোবাদের মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা একরাশ কষ্টের গল্প টিভির টক শো কিংবা পত্রিকার পাতা অথবা আলোচনা অনুষ্ঠানে উঠে আসে না। কারন এতে হয়তো কাটতি তেমন হয় না। এর চেয়ে খবর হিসেবে “চিকিৎসকের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু” অনেক বেশী আকর্ষনীয় আমাদের কষ্ট বোঝার কেউ কি আছেন বাংলাদেশে?

 এই নির্মম দাস প্রথার অবসান চাই। শেয়ার করতে বলা আমার অভ্যাস নয়। চিকিৎসক ও যারা সমব্যাথী হবেন তাদের শেয়ার করার অনুরোধ জানাচ্ছি। চিকিৎসকদের জীবনের এই অংশটা মানুষ জানে না। জানানো দরকার।

>> কালেক্টেড পোস্ট <<

No comments:

Post a Comment